ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপের আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেডের ফাঁকি দেওয়া ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার শুল্ক ও কর নিয়ে বিপাকে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
আদানি পাওয়ার থেকে আমদানি করা বিদ্যুতে ওই রাজস্ব আদায় না হওয়ায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিরুদ্ধেই শুল্ক-কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। যা ইতোমধ্যে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ফাঁকি দেওয়া ওই শুল্ক-কর আদায়ে একের পর এক কারণ দর্শানোর নোটিশ ও তাগিদপত্র দেওয়ার পরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ২৮ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল স্টেশন থেকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাগিদপত্র দেওয়া হয়। তবে বিপিডিবি থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে এ বিষয়ে সরকার কি সিদ্ধান্ত নেয় এখনো তার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। যার ফলে আদতে ওই রাজস্ব আদায় হবে কি না তা নিয়েই সংশয় রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়ে গাফলতি কিংবা অনিয়মের সঙ্গে জড়িতের শনাক্তে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের পাশাপাশি মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস (চুক্তির সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ছিলেন) ও তার নেতৃত্বাধীন অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এনবিআরকে পাশ কাটিয়ে আদানির সঙ্গে চুক্তি করার অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুদকের অনুসন্ধানী টিম। সংস্থাটির উপপরিচালক রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একটি টিম ওই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এখন পর্যন্ত নথিপত্র তলব ও সংগ্রহ ছাড়া অনুসন্ধান কাজের তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে।
অর্থাৎ একদিকে ফাঁকি দেওয়া সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় ও অন্যদিকে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করার দুটো কাজই চলমান রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ ও রাজস্ব আদায়ের তেমন অগ্রগতি নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, চুক্তির আদ্যোপান্ত জানতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে চুক্তির যাবতীয় রেকর্ডপত্র, ক্রয় প্রক্রিয়া, বিভাগীয় তদন্ত হয়ে থাকলে তার অনুলিপি ও তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তথ্যসহ চার ধরনের নথি চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। কিছু নথিপত্র দুদকে এসেছে। এখন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে শুল্ক-কর আদায়সহ আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আদানি পাওয়ার থেকে বিপিডিবির আমদানি করা বিদ্যুতে শুল্ক-কর পরিশোধ হয়নি, অথচ এ বিষয়ে এনবিআর থেকে কোনো ধরনের ছাড় অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এটি একটি স্পষ্ট শুল্ক ফাঁকি, যা রাজস্ব আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ নিয়মে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। একাধিকবার সময় বাড়িয়েও লিখিত জবাব পাওয়া যায়নি। জবাব না পেলে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমদানি কার্যক্রমে শুল্কছাড় পেতে হলে এনবিআরের সুস্পষ্ট অনুমোদন প্রয়োজন। আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে সেই অনুমোদন ছিল না। অথচ বিপিডিবি সেটা না মেনে শুল্কছাড় দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানি করেছে, যা নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার শামিল। সরকার এর মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শুল্ক-কর আদায় প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ও বোর্ড সচিব রাশেদুল হক প্রধানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। উপদেষ্টা পর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমাদের সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে ভারতীয় সরকারি বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেডের মতো শুল্কছাড়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কোনো ছাড় অনুমোদন না হওয়া সত্ত্বেও বিপিডিবি শুল্ক-কর ছাড়াই বিদ্যুৎ আমদানি করে শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়েছে। আদানি গ্রুপের মাধ্যমে আমদানি করা বিদ্যুতে শুল্ক অব্যাহতির কোনো নির্দেশনা না থাকায় এটি সরাসরি শুল্ক ফাঁকির শামিল বলে করছে এনবিআর। বিষয়টি জানিয়ে কাস্টমস অধিদপ্তর ১৫ কার্যদিবস সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। পরে আরও দুই দফায় সময় বাড়িয়ে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। তবুও বিপিডিবি কোনো লিখিত জবাব দেয়নি। সর্বশেষ এনবিআর আবারও ১০ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলেছে, অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান বরাবর সর্বশেষ গত ২৮ জুন রাজশাহী কমিশনারেটের আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল কাস্টমস স্টেশন থেকে চিঠি দিয়ে তাগিদ দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী আদানি পাওয়ার থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে শুল্ক-কর বাবদ ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধ না করায় সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠির সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায়সহ বিপিডিবির বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন ২০২৩ এর ধারা ৯০ ও ১৭১ (১) ধারা অনুযায়ী রাজশাহী কমিশনারেট বা বৃহৎ করদাতা ইউনিটকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী কমিশনারেট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ দর্শানোর নোটিশে ১৫ কর্মদিবস সময় দেওয়া ছিল। পরে বিপিডিবির অনুরোধে সময় দুই মাস বৃদ্ধি করা হয়। পরে আরও এক মাস সময় বৃদ্ধি করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ওই এক মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব পাওয়া যায়নি। যে কারণে পরিহার করা রাজস্ব আদায় ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না তা জানাতে গত ২৮ জুন লিখিতভাবে রাজশাহী কমিশনারেটের আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল কাস্টমস স্টেশন থেকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ব্যক্তিগত শুনানি প্রদানে ইচ্ছুক হলে তাও লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য নেই ধরে পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলে বলা হয় চিঠিতে।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি খতিয়ে দেখতে ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য ও তার ওপর শুল্ক-কর আদায়যোগ্য কি না, প্রযোজ্য হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না এবং শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অনুমতি দিয়েছিল কি না– এসব বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি। গত ৩ নভেম্বর ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দেয়।
প্রতিবেদনের মূল বিষয় হলো– ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির কাছ থেকে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলারের বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এই আমদানি করা বিদ্যুতে ৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ আগাম করসহ মোট করভার ৩১ শতাংশ। সে হিসাবে আদানির কাছ থেকে এনবিআরের পাওনা রাজস্বের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলার, যা প্রায় ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার সমান। যেহেতু এনবিআর আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো শুল্ক-কর অব্যাহতির আদেশ জারি করেনি, সেহেতু আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর আদায়যোগ্য। দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ২০২৩ অনুযায়ী, আমদানি পর্যায়ে কর ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে শাস্তিমূলক জরিমানা, সুদ এমনকি আইনি প্রক্রিয়ায় ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করাও সম্ভব।
আদানির সঙ্গে চুক্তির আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ ভারতের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড থেকে বিদ্যুৎ কেনে। এক্ষেত্রেও এনবিআর শুল্ক অব্যাহতি সংক্রান্ত আদেশ জারি করেনি। ফলে এনটিপিসি থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ শুল্ক-কর ফাঁকির দায় এড়াতে পারে না।
শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি সই করে। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে কঠোর গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। চুক্তির খসড়ার ওপর মতামত দিতে সরকারের অন্য কোনো দপ্তরে পাঠানো হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ২০২২ সালের শেষের দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি। নিয়ম অনুযায়ী সরকার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামত নিয়ে থাকে। রহনপুর কাস্টমস স্টেশন দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির নিয়ম না থাকলেও তা করা হয়েছে। অনিয়ম ও ক্ষমতার দাপটে বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করা হয়নি। অথচ যেকোনো ধরনের আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই ছিল অবৈধ ও ক্ষমতার নগ্ন হস্তক্ষেপ। এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ নেই বলে মনে করে এনবিআর।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরকে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি খসড়া পাঠাতে এনবিআর ২০২৩ সালের ২ মার্চ, ২২ মার্চ ও ১৩ এপ্রিল বিদ্যুৎ বিভাগে তিন দফায় চিঠি দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে খসড়া পাঠানো হয়নি। এ কারণে এ বিষয়ে এনবিআর মতামত দিতে পারেনি। পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে আদানিকে অব্যাহতি দিয়ে চুক্তি করে। এখানে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’ কে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে। এসব চুক্তির আওতায় তিনটি পথে প্রায় দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কুমিল্লা আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে আসে বিদ্যুৎ। তবে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য শুল্ক-কর সংক্রান্ত ছাড়পত্র জারি হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ছাড়ের কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এ ছাড়া আদানিসহ বিভিন্ন পথে যে বিদ্যুৎ আসছে, এর জন্য শুল্ক আইন মেনে বিভিন্ন শুল্ক স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু কখনো বিল অব এন্ট্রি জমার তথ্য নেই কাস্টমসের কাছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে কাস্টমস গোয়েন্দা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তিতে শুল্কে অনিয়ম খুঁজতে ৯ কর্মকর্তার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে। কমিটির দায়িত্ব ছিল ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের দায় শোধ, প্রতি ইউনিটের দাম, প্রযোজ্য শুল্ক-কর ও শুল্ক আইন মেনে আমদানি করার সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খতিয়ে দেখা। তবে তদন্তে অনিয়মের ছড়াছড়ি ছাড়া নিয়মের কিছুই খুঁজে পায়নি কমিটি।
প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় নির্মিত। বাংলাদেশের মনকষা সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় অবস্থিত ৪০০/১৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এই গ্রিড উপকেন্দ্র রহনপুর কাস্টমস স্টেশন থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু আদানির কাছ থেকে পিডিবি যে রুটে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালন করে তা কাস্টমস আইন ২০২৩ অনুযায়ী কাস্টমস স্টেশন হিসেবে অনুমোদিত নয়। দেশে সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি পিডিবির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তবে তাদের বিদ্যুৎ আমদানির কোনো বিল অব এন্ট্রি কাস্টমসে দাখিল করা হয়নি। তাছাড়া রহনপুর শুল্ক স্টেশনের আমদানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় বিদ্যুৎই নেই।
আদানি পাওয়ার থেকে আমদানি করা বিদ্যুতে ওই রাজস্ব আদায় না হওয়ায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিরুদ্ধেই শুল্ক-কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। যা ইতোমধ্যে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ফাঁকি দেওয়া ওই শুল্ক-কর আদায়ে একের পর এক কারণ দর্শানোর নোটিশ ও তাগিদপত্র দেওয়ার পরও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ২৮ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল স্টেশন থেকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাগিদপত্র দেওয়া হয়। তবে বিপিডিবি থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে এ বিষয়ে সরকার কি সিদ্ধান্ত নেয় এখনো তার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। যার ফলে আদতে ওই রাজস্ব আদায় হবে কি না তা নিয়েই সংশয় রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়ে গাফলতি কিংবা অনিয়মের সঙ্গে জড়িতের শনাক্তে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের পাশাপাশি মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস (চুক্তির সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ছিলেন) ও তার নেতৃত্বাধীন অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এনবিআরকে পাশ কাটিয়ে আদানির সঙ্গে চুক্তি করার অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুদকের অনুসন্ধানী টিম। সংস্থাটির উপপরিচালক রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একটি টিম ওই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এখন পর্যন্ত নথিপত্র তলব ও সংগ্রহ ছাড়া অনুসন্ধান কাজের তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে।
অর্থাৎ একদিকে ফাঁকি দেওয়া সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় ও অন্যদিকে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করার দুটো কাজই চলমান রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ ও রাজস্ব আদায়ের তেমন অগ্রগতি নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, চুক্তির আদ্যোপান্ত জানতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে চুক্তির যাবতীয় রেকর্ডপত্র, ক্রয় প্রক্রিয়া, বিভাগীয় তদন্ত হয়ে থাকলে তার অনুলিপি ও তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তথ্যসহ চার ধরনের নথি চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। কিছু নথিপত্র দুদকে এসেছে। এখন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে শুল্ক-কর আদায়সহ আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আদানি পাওয়ার থেকে বিপিডিবির আমদানি করা বিদ্যুতে শুল্ক-কর পরিশোধ হয়নি, অথচ এ বিষয়ে এনবিআর থেকে কোনো ধরনের ছাড় অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এটি একটি স্পষ্ট শুল্ক ফাঁকি, যা রাজস্ব আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ নিয়মে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। একাধিকবার সময় বাড়িয়েও লিখিত জবাব পাওয়া যায়নি। জবাব না পেলে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমদানি কার্যক্রমে শুল্কছাড় পেতে হলে এনবিআরের সুস্পষ্ট অনুমোদন প্রয়োজন। আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে সেই অনুমোদন ছিল না। অথচ বিপিডিবি সেটা না মেনে শুল্কছাড় দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানি করেছে, যা নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার শামিল। সরকার এর মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শুল্ক-কর আদায় প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ও বোর্ড সচিব রাশেদুল হক প্রধানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। উপদেষ্টা পর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমাদের সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে ভারতীয় সরকারি বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেডের মতো শুল্কছাড়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কোনো ছাড় অনুমোদন না হওয়া সত্ত্বেও বিপিডিবি শুল্ক-কর ছাড়াই বিদ্যুৎ আমদানি করে শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়েছে। আদানি গ্রুপের মাধ্যমে আমদানি করা বিদ্যুতে শুল্ক অব্যাহতির কোনো নির্দেশনা না থাকায় এটি সরাসরি শুল্ক ফাঁকির শামিল বলে করছে এনবিআর। বিষয়টি জানিয়ে কাস্টমস অধিদপ্তর ১৫ কার্যদিবস সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। পরে আরও দুই দফায় সময় বাড়িয়ে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। তবুও বিপিডিবি কোনো লিখিত জবাব দেয়নি। সর্বশেষ এনবিআর আবারও ১০ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলেছে, অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান বরাবর সর্বশেষ গত ২৮ জুন রাজশাহী কমিশনারেটের আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল কাস্টমস স্টেশন থেকে চিঠি দিয়ে তাগিদ দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী আদানি পাওয়ার থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে শুল্ক-কর বাবদ ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধ না করায় সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠির সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায়সহ বিপিডিবির বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন ২০২৩ এর ধারা ৯০ ও ১৭১ (১) ধারা অনুযায়ী রাজশাহী কমিশনারেট বা বৃহৎ করদাতা ইউনিটকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী কমিশনারেট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ দর্শানোর নোটিশে ১৫ কর্মদিবস সময় দেওয়া ছিল। পরে বিপিডিবির অনুরোধে সময় দুই মাস বৃদ্ধি করা হয়। পরে আরও এক মাস সময় বৃদ্ধি করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ওই এক মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব পাওয়া যায়নি। যে কারণে পরিহার করা রাজস্ব আদায় ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না তা জানাতে গত ২৮ জুন লিখিতভাবে রাজশাহী কমিশনারেটের আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর স্থল কাস্টমস স্টেশন থেকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ব্যক্তিগত শুনানি প্রদানে ইচ্ছুক হলে তাও লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য নেই ধরে পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলে বলা হয় চিঠিতে।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি খতিয়ে দেখতে ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য ও তার ওপর শুল্ক-কর আদায়যোগ্য কি না, প্রযোজ্য হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে কি না এবং শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অনুমতি দিয়েছিল কি না– এসব বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি। গত ৩ নভেম্বর ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দেয়।
প্রতিবেদনের মূল বিষয় হলো– ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির কাছ থেকে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলারের বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এই আমদানি করা বিদ্যুতে ৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ আগাম করসহ মোট করভার ৩১ শতাংশ। সে হিসাবে আদানির কাছ থেকে এনবিআরের পাওনা রাজস্বের পরিমাণ ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলার, যা প্রায় ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার সমান। যেহেতু এনবিআর আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো শুল্ক-কর অব্যাহতির আদেশ জারি করেনি, সেহেতু আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর আদায়যোগ্য। দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ২০২৩ অনুযায়ী, আমদানি পর্যায়ে কর ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে শাস্তিমূলক জরিমানা, সুদ এমনকি আইনি প্রক্রিয়ায় ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করাও সম্ভব।
আদানির সঙ্গে চুক্তির আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ ভারতের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড থেকে বিদ্যুৎ কেনে। এক্ষেত্রেও এনবিআর শুল্ক অব্যাহতি সংক্রান্ত আদেশ জারি করেনি। ফলে এনটিপিসি থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ শুল্ক-কর ফাঁকির দায় এড়াতে পারে না।
শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি সই করে। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে কঠোর গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। চুক্তির খসড়ার ওপর মতামত দিতে সরকারের অন্য কোনো দপ্তরে পাঠানো হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ২০২২ সালের শেষের দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি। নিয়ম অনুযায়ী সরকার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামত নিয়ে থাকে। রহনপুর কাস্টমস স্টেশন দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির নিয়ম না থাকলেও তা করা হয়েছে। অনিয়ম ও ক্ষমতার দাপটে বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করা হয়নি। অথচ যেকোনো ধরনের আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই ছিল অবৈধ ও ক্ষমতার নগ্ন হস্তক্ষেপ। এই প্রক্রিয়ায় যেকোনো ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ নেই বলে মনে করে এনবিআর।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরকে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি খসড়া পাঠাতে এনবিআর ২০২৩ সালের ২ মার্চ, ২২ মার্চ ও ১৩ এপ্রিল বিদ্যুৎ বিভাগে তিন দফায় চিঠি দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে খসড়া পাঠানো হয়নি। এ কারণে এ বিষয়ে এনবিআর মতামত দিতে পারেনি। পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে আদানিকে অব্যাহতি দিয়ে চুক্তি করে। এখানে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’ কে তা স্পষ্ট করা হয়নি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে। এসব চুক্তির আওতায় তিনটি পথে প্রায় দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কুমিল্লা আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে আসে বিদ্যুৎ। তবে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য শুল্ক-কর সংক্রান্ত ছাড়পত্র জারি হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ছাড়ের কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এ ছাড়া আদানিসহ বিভিন্ন পথে যে বিদ্যুৎ আসছে, এর জন্য শুল্ক আইন মেনে বিভিন্ন শুল্ক স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু কখনো বিল অব এন্ট্রি জমার তথ্য নেই কাস্টমসের কাছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে কাস্টমস গোয়েন্দা আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তিতে শুল্কে অনিয়ম খুঁজতে ৯ কর্মকর্তার সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে। কমিটির দায়িত্ব ছিল ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের দায় শোধ, প্রতি ইউনিটের দাম, প্রযোজ্য শুল্ক-কর ও শুল্ক আইন মেনে আমদানি করার সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খতিয়ে দেখা। তবে তদন্তে অনিয়মের ছড়াছড়ি ছাড়া নিয়মের কিছুই খুঁজে পায়নি কমিটি।
প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় নির্মিত। বাংলাদেশের মনকষা সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় অবস্থিত ৪০০/১৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এই গ্রিড উপকেন্দ্র রহনপুর কাস্টমস স্টেশন থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু আদানির কাছ থেকে পিডিবি যে রুটে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালন করে তা কাস্টমস আইন ২০২৩ অনুযায়ী কাস্টমস স্টেশন হিসেবে অনুমোদিত নয়। দেশে সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি পিডিবির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তবে তাদের বিদ্যুৎ আমদানির কোনো বিল অব এন্ট্রি কাস্টমসে দাখিল করা হয়নি। তাছাড়া রহনপুর শুল্ক স্টেশনের আমদানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় বিদ্যুৎই নেই।