মাইলস্টোন কলেজের বিমান দুর্ঘটনায় গোটা জাতি যখন শোকাচ্ছন্ন; তখন হঠাৎ খবর এলো পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন হাসিনার কৃতদাস সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। বিচার বিভাগের এক কুলাঙ্গার রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করেছিলেন। দিল্লির নাচের পুতুল শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হলের একটি মামলাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেত্রীর ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় ঠেলে দেন। অবসরে গিয়ে রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর মূল রায় পাল্টিয়ে জালিয়াতি করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেন। দিল্লি নীলনকশায় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে আওয়ামীকরণ করার পুরস্কার হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ দখলে রাখেন। মাফিয়া রানী হাসিনা তাকে প্লট, ফ্ল্যাট উপহার দেন। নিজের চিকিৎসার জন্য ত্রাণ তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন। বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্বিগ্ন মানুষের উৎকণ্ঠিত চোখ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার দিকে থাকলেও খায়রুল হক গ্রেফতারের খবর শুনে নড়েচড়ে বসেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেরিতে হলেও খায়রুল হক গ্রেফতার হওয়ায় মানুষ দারুণ খুশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধৃত খায়রুল ধরা পড়েছে মুহূতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যান। এখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত খায়রুলের বিচার হবে এক সময় নেতৃত্বে পরিচালিত আদালতে।
কথাবার্তায় ভদ্র এবং চলাফেরায় স্মার্ট হলেও শেয়ালের মতো ধৃত খায়রুল হক আওয়ামী লীগ রেজিমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচার ব্যবস্থাকে দিল্লির ইচ্ছাপূরণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, আইন অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা তার কাছে হয়ে উঠেছিল গৌণ। তিনি মূলত মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। উচ্চ আদালতের প্রতি নাগরিকের বরাবর ‘পূর্ণ আস্থা’র বিশ্বাসে ধ্বস নামিয়ে বিচারক হিসেবে নিজেকে কলঙ্কিত করেন। দেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার পথ ধরেই পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি পদে বসা এস কে সিনহা দিল্লির ইচ্ছামতো বিচার বিভাগ পরিচালনা করেন। তবে হাইকোর্টের ‘শেখ মুজিব জাতির পিতা’ ইস্যু এবং ‘কোনো এক ব্যক্তির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি’ পর্যবেক্ষণে বিক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনা তাকে (এস কে সিনহা) দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন।
ভারতের পরীক্ষিত দালাল খায়রুল হক ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পান। তিনি ছিলেন দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে দেশের গোটা বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে ২০১১ সালের ১৭ মে অবসরে যান। তার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। ওই বিতর্কিত রায়ে পর্যবেক্ষণে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ অভিমত দেন। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে তিনি সঙ্কটের সূচনা করেছিলেন। পরে মাফিয়া রানী হাসিনা সংসদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতির রায় ঘোষণার পর অবসরে গিয়ে ১৬ মাস ধরে তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। সেখানে তিনি হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ জালিয়াতির মাধ্যমে পাল্টে দেন। রায়ে তিনি সংযোজন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত দলবাজ একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া, বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মধ্যদিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদ শেকড় গাড়ে।
এর আগে হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন। তিনি ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দিয়েছেন। এছাড়া তিনি ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ বিভিন্ন মামলার রায় দেন। শেখ হাসিনার ইচ্ছামতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত পরিচালনা করা এবং আওয়ামী লীগের পছন্দমতো মামলার রায় ঘোষণার পুরস্কার হিসেবে খায়রুল হককে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ উপহার দেয়া হয়। তিনি ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। মেয়াদ শেষ হলেও কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনঃনিয়োগ করা হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানোর পর ১৩ আগস্ট আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে আত্মগোপন করেন।
দেশের বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্কিত বিতর্কিত এবং শেয়ালের মতো ধূর্ত এ বি এম খায়রুল হক ১৯৭০ সালে জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন। নিম্ন আদালতে কয়েক বছর আইনজীবীর কাজ করার পর ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। দীর্ঘ ২৫ বছর হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ওকালতি করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিল্লির নীলনকশা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা ২০১০ সালে তাকে আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীমের অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়।
দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিচারপতি খায়রুল হকের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক ওঠেছিল। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো একে স্বাগত জানালেও বিরোধী দলগুলো তীব্র আপত্তি জানায়। ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের ১৬ মাস পরে ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসরে থাকাবস্থায় তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি বাদ দেন। এর আগে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছিল ‘সংসদ চাইলে পরবর্তী দুই মেয়াদে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা যাবে না।’ জালিয়াতি করে খায়রুল হক রায় থেকে এই অংশ বাদ দেন। এমনকি, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসঙ্গতি নিয়ে তখনই জোরালো বিতর্ক উঠেছিল।
বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। কিন্তু রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী থানার যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল রাতে পৌনে ৮টার দিকে তাকে আদালতে নেয়া হয়। এরপর তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজতখানায় রাখা হয়। রাত সোয়া ৮টায় তাকে এজলাসে তোলা হয়। খায়রুল হককে এজলাসে নেয়ার সময় উপস্থিত আইনজীবীরা দুয়ো ধ্বনি দেন। তারা ‘খায়রুলের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক খালেদ হাসান তাকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্যাহর আদালতে তার জামিন শুনানি হয়। আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে তার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে রাখার আবেদন করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত বছরের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
এ বি এম খায়রুল হক গ্রেফতার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। বিগত হাসিনা রেজিমে যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তারা দারুণ খুশি। রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসে খায়রুল গ্রেফতার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাকে রিমান্ডে এনে কি কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর অবসরে থেকে জালিয়াতি করে রায় লেখার রহস্য জানাতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে ওই জায়গাটিতে বসে, সেই জায়গা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে না পারে। খায়রুল দেশের একজন বড় শত্রু, যিনি বিরাট একটা পদে থেকে দেশের বিশাল ক্ষতি করেছেন। দেশের ভাগ্য নির্ধারণে দায়িত্বে থেকে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছিলেন, শর্ট যে রায় দিয়েছিলেন তার পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ যে রায়-আকাশ আর পাতাল তফাৎ ছিল। যে রায় তিনি দিয়েছিলেন, সেটিও আমরা মনে করি যে, এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে।’
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে প্লট বরাদ্দ নেয়ায় এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। গতকাল দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুদক মহাপরিচালক জানান, ২০০৩ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ পান বিচারপতি খায়রুল হক। প্লট বরাদ্দের শর্ত মোতাবেক প্রথম কিস্তির সাড়ে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ না করায় রাজউক বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বিগত সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পুনরায় আইন ও বিধি বহির্ভূতভাবে প্লট হস্তান্তর গ্রহণ করেন। পুরো টাকা না দিয়ে ছয় বছর আগের প্রথম কিস্তির টাকার চেক জমা দেন, যা নগদায়ন হয়নি। তারপরও অবসর গ্রহণের পরে যাবতীয় পাওনা পরিশোধের শর্তে তাকে অবৈধভাবে প্লট হস্তান্তর করা হয়।
                           কথাবার্তায় ভদ্র এবং চলাফেরায় স্মার্ট হলেও শেয়ালের মতো ধৃত খায়রুল হক আওয়ামী লীগ রেজিমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচার ব্যবস্থাকে দিল্লির ইচ্ছাপূরণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, আইন অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা তার কাছে হয়ে উঠেছিল গৌণ। তিনি মূলত মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। উচ্চ আদালতের প্রতি নাগরিকের বরাবর ‘পূর্ণ আস্থা’র বিশ্বাসে ধ্বস নামিয়ে বিচারক হিসেবে নিজেকে কলঙ্কিত করেন। দেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার পথ ধরেই পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি পদে বসা এস কে সিনহা দিল্লির ইচ্ছামতো বিচার বিভাগ পরিচালনা করেন। তবে হাইকোর্টের ‘শেখ মুজিব জাতির পিতা’ ইস্যু এবং ‘কোনো এক ব্যক্তির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি’ পর্যবেক্ষণে বিক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনা তাকে (এস কে সিনহা) দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন।
ভারতের পরীক্ষিত দালাল খায়রুল হক ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পান। তিনি ছিলেন দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে দেশের গোটা বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে ২০১১ সালের ১৭ মে অবসরে যান। তার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। ওই বিতর্কিত রায়ে পর্যবেক্ষণে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ অভিমত দেন। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে তিনি সঙ্কটের সূচনা করেছিলেন। পরে মাফিয়া রানী হাসিনা সংসদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতির রায় ঘোষণার পর অবসরে গিয়ে ১৬ মাস ধরে তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। সেখানে তিনি হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ জালিয়াতির মাধ্যমে পাল্টে দেন। রায়ে তিনি সংযোজন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত দলবাজ একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া, বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মধ্যদিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদ শেকড় গাড়ে।
এর আগে হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন। তিনি ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দিয়েছেন। এছাড়া তিনি ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ বিভিন্ন মামলার রায় দেন। শেখ হাসিনার ইচ্ছামতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত পরিচালনা করা এবং আওয়ামী লীগের পছন্দমতো মামলার রায় ঘোষণার পুরস্কার হিসেবে খায়রুল হককে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ উপহার দেয়া হয়। তিনি ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। মেয়াদ শেষ হলেও কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনঃনিয়োগ করা হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানোর পর ১৩ আগস্ট আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে আত্মগোপন করেন।
দেশের বিচার বিভাগের জন্য কলঙ্কিত বিতর্কিত এবং শেয়ালের মতো ধূর্ত এ বি এম খায়রুল হক ১৯৭০ সালে জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন। নিম্ন আদালতে কয়েক বছর আইনজীবীর কাজ করার পর ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। দীর্ঘ ২৫ বছর হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ওকালতি করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিল্লির নীলনকশা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ওয়ান-ইলেভেনের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা ২০১০ সালে তাকে আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীমের অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়।
দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নির্দেশে বিচারপতি খায়রুল হকের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক ওঠেছিল। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো একে স্বাগত জানালেও বিরোধী দলগুলো তীব্র আপত্তি জানায়। ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের ১৬ মাস পরে ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসরে থাকাবস্থায় তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি বাদ দেন। এর আগে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছিল ‘সংসদ চাইলে পরবর্তী দুই মেয়াদে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা যাবে না।’ জালিয়াতি করে খায়রুল হক রায় থেকে এই অংশ বাদ দেন। এমনকি, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসঙ্গতি নিয়ে তখনই জোরালো বিতর্ক উঠেছিল।
বহুল আলোচিত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। কিন্তু রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী থানার যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল রাতে পৌনে ৮টার দিকে তাকে আদালতে নেয়া হয়। এরপর তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজতখানায় রাখা হয়। রাত সোয়া ৮টায় তাকে এজলাসে তোলা হয়। খায়রুল হককে এজলাসে নেয়ার সময় উপস্থিত আইনজীবীরা দুয়ো ধ্বনি দেন। তারা ‘খায়রুলের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক খালেদ হাসান তাকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্যাহর আদালতে তার জামিন শুনানি হয়। আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে তার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে রাখার আবেদন করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত বছরের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে যুবদলকর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
এ বি এম খায়রুল হক গ্রেফতার রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। বিগত হাসিনা রেজিমে যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তারা দারুণ খুশি। রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসে খায়রুল গ্রেফতার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাকে রিমান্ডে এনে কি কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর অবসরে থেকে জালিয়াতি করে রায় লেখার রহস্য জানাতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে ওই জায়গাটিতে বসে, সেই জায়গা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে না পারে। খায়রুল দেশের একজন বড় শত্রু, যিনি বিরাট একটা পদে থেকে দেশের বিশাল ক্ষতি করেছেন। দেশের ভাগ্য নির্ধারণে দায়িত্বে থেকে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছিলেন, শর্ট যে রায় দিয়েছিলেন তার পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ যে রায়-আকাশ আর পাতাল তফাৎ ছিল। যে রায় তিনি দিয়েছিলেন, সেটিও আমরা মনে করি যে, এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে।’
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে প্লট বরাদ্দ নেয়ায় এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। গতকাল দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুদক মহাপরিচালক জানান, ২০০৩ সালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ পান বিচারপতি খায়রুল হক। প্লট বরাদ্দের শর্ত মোতাবেক প্রথম কিস্তির সাড়ে ছয় লাখ টাকা পরিশোধ না করায় রাজউক বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বিগত সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পুনরায় আইন ও বিধি বহির্ভূতভাবে প্লট হস্তান্তর গ্রহণ করেন। পুরো টাকা না দিয়ে ছয় বছর আগের প্রথম কিস্তির টাকার চেক জমা দেন, যা নগদায়ন হয়নি। তারপরও অবসর গ্রহণের পরে যাবতীয় পাওনা পরিশোধের শর্তে তাকে অবৈধভাবে প্লট হস্তান্তর করা হয়।
 
  অনলাইন ডেস্ক
 অনলাইন ডেস্ক  
                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                     
                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                