রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এক ১৬ বছর বয়সী ছাত্রী তার পূর্ব শিক্ষক মারুফ কারখী কে ছুরিকাঘাত করে গলা ও হাতে জখম হয় করে। মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) দুপুর পৌনে ২টার দিকে স্কুলের প্রধান গেটে এই ঘটনা ঘটে।
আহত শিক্ষক মারুফ কারখী (৩৪), তিনি রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক (বাংলা)। তার গলা ও হাতে জখম হয়, তিনটি সেলাই দিতে হয়েছে। ২০২৩ সালে সাইবার অপরাধ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (টিসি) দেওয়ার ক্ষোভ থেকে এই হামলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাটি স্কুলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ও সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
অভিযুক্ত সাবেক ছাত্রী ১৬ বছরে তরুণী, সে ২০২৩ সালে ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে’ তাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে টিসি দেওয়া হয়। বর্তমানে সে রাজশাহীর শহীদ কর্ণেল কাজী এমদাদুল হক পাবলিক স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্কুল ছুটির পর মারুফ কারখী, যিনি সহকারী শিক্ষক (বাংলা), স্কুটিতে বাসায় ফিরছিলেন। ছাত্রীটি ‘হেল্প, হেল্প’ বলে ডেকে তাঁকে থামান এবং ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে গলায় হামলা করেন। শিক্ষক প্রতিরোধ করলে তাঁর গলা ও হাতে ক্ষত হয়। তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসার পর তিনি বাসায় ফিরে যান। স্থানীয়রা ছাত্রীকে আটক করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে খবর দেন, এবং তাঁকে অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
স্কুল সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ছাত্রী বর্তমানে শহীদ কর্ণেল কাজী এমদাদুল হক পাবলিক স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০২৩ সালে ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন তিনি এক আত্মীয়ের সাহায্যে এক শিক্ষকের ফোন নম্বর ক্লোন করে অন্য শিক্ষকদের অশ্লীল মেসেজ, ছবি ও ভিডিও পাঠাতেন। সাইবার টিমের তদন্তে তিনি ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন, যার ফলে তাঁকে টিসি দেওয়া হয়।
স্কুলের এক কর্মকর্তা বলেন, “ছাত্রীটির শুধু মারুফ কারখীর প্রতি নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি ক্ষোভ ছিল। কাকতালীয়ভাবে রাস্তায় মারুফের সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে হামলা চালায়।” একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হামলার পর ছাত্রী স্কুল কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র গাজিউর রহমান বলেন, “এটি একটি অপ্রীতিকর ঘটনা। তবে এখনো কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বোয়ালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তারা জানিয়েছে, বিষয়টি নিজেরাই সমাধান করবে। থানায় কোনো অভিযোগ হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশ পেনাল কোডের ধারা ৩২৪ (স্বেচ্ছায় বিপজ্জনক অস্ত্র দিয়ে আঘাত) এবং ৩৫১(২) (অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন) অনুযায়ী এই ঘটনা তদন্তযোগ্য।
এই ঘটনা স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং শিক্ষকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। স্থানীয় অভিভাবক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বাচ্চারা স্কুলে নিরাপদ নয়, এটা ভাবতেই ভয় লাগে।” স্থানীয় শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি আব্দুল হক বলেন, “এই ঘটনা শিক্ষকদের মনে ভয় তৈরি করেছে। আমরা নিরাপত্তা চাই।” ইন্টারনেট রিসার্চ অনুসারে, বাংলাদেশে স্কুলে ৪৪.৪% ছাত্র বুলিংয়ের শিকার হয়, এবং সাইবার বুলিংয়ের হার ১৩.৬% থেকে ৪৫%। ইউনিসেফের সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৫% যুবক সাইবার বুলিংয়ের শিকার, যা মানসিক চাপ এবং প্রতিশোধমূলক আচরণের দিকে ঠেলে দেয়। ২০২৫ সালে স্কুলে সহিংসতার ঘটনা ১৫% বেড়েছে।
রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, যা সেনাবাহিনী-পরিচালিত এবং উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত, এমন ঘটনা স্কুলের কঠোর শৃঙ্খলা নীতির পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ছাত্রদের মধ্যে ৩০% মানসিক চাপে ভোগে, যা এই হামলার মতো ঘটনার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
স্কুলে সহিংসতা এবং সাইবার অপরাধ রোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্কুলগুলোতে সাইবার সুরক্ষা প্রশিক্ষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। ইউনিসেফ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় অ্যান্টি-বুলিং ক্যাম্পেইন শুরু করা উচিত। সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালকে সক্রিয় করে সাইবার বুলিংয়ের জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল প্রশাসনকে ছাত্রদের ক্ষোভ মোকাবিলায় কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করতে হবে, যাতে টিসির মতো শাস্তির পরিবর্তে পুনর্বাসন সম্ভব হয়। রাজশাহী পুলিশকে তদন্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুল ক্যাম্পাসে সিসিটিভি এবং নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত।