রাজশাহী ভারতীয় ভিসা সেন্টারের ভেতরে ভিড়। কেউ ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউবা উদ্বিগ্ন চোখে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে। সকালের কড়া রোদ পেরিয়ে দুপুর গড়িয়েছে, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো মানুষের অপেক্ষার শেষ নেই। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চান। কিন্তু আশার সেই ভিসা আবেদনই হয়ে উঠছে দুঃস্বপ্ন। প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ভুয়া চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে দিনাজপুর থেকে রাজকুমার রায় নামের এক ব্যক্তি এসেছিলেন রাজশাহী ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে। অন্যান্য ভিসা প্রত্যাশীর মতো তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন লাইনে। বুকে ব্যথা ও শরীরে টিউমারের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। আশায় বুক বেঁধে ভিসা জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি জানতে পারলেন, তার জমা দেওয়া সব রিপোর্টই ভুয়া। এমনকি যে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন তিনি দিয়েছেন, তিনি কখনোই সেই চিকিৎসকের কাছে যাননি।
হতাশ কণ্ঠে রাজকুমার বলেন, ‘আমি জানতামই না কাগজগুলো ভুয়া। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করি। তারা শুধু এনআইডি আর জমির দলিল নিতে বলেছিল। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে। পরে আবার দেড় হাজার টাকা দাবি করেছে। আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের তথ্য বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০টি ভিসা আবেদন জমা পড়ে রাজশাহীতে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টিতে ধরা পড়ছে জাল কাগজ। খ্যাতনামা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে এসব রিপোর্ট। ফলে ভিসা প্রত্যাখ্যান হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ পড়ছেন মারাত্মক ভোগান্তিতে।
ভিসা সেন্টারের এক কর্মকর্তা বলেন, কিছু অসাধু দালাল মানুষের সরলতাকে কাজে লাগাচ্ছে। তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নকল প্রেসক্রিপশন ও রিপোর্ট বানিয়ে দেয়। অনেক সময় ভিসা মিলে গেলেও ভারতে গিয়ে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এরই মধ্যে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এজন্য ভিসার বিষয়ে আমরা বেশ কঠোরতা অবলম্বন করি, যাতে ভারতে গিয়ে কেউ ভোগান্তির শিকার না হন।
সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন আবেদনকারী জানান, দালালরা অনেকটা ‘সহজ সমাধান’ দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। তারা বলে, শুধু পরিচয়পত্র দিলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর তাতেই ঝুঁকছেন অনেকে, বিশেষ করে যারা গ্রামাঞ্চল থেকে আসছেন ও কাগজপত্র তৈরির ঝামেলায় যেতে চান না।
একজন আবেদনকারী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম দালালরা কাজটা সহজ করছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তারা আসলে সর্বনাশ করছে।’
ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের কর্মকর্তা মনোজ কুমার সতর্ক করে বলেন, ‘সত্যিকারের কাগজ থাকলে ভিসা পেতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দালালদের মাধ্যমে গেলে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ভুয়া কাগজ জমা দিলে আমরা কঠোরভাবে তা প্রত্যাখ্যান করছি। বাংলাদেশের প্রশাসনকেও এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে।’
ভিসা প্রার্থীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, তাদের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না এ নিয়ে তারা তারা ভয়ের মধ্যে আছেন। দালালের খপ্পরে না পড়ে ভিসা পাবেন কি না এ নিয়ে শঙ্কায় শতশত মানুষ।
রাজশাহীর ভিসা সেন্টারে তাই এখন প্রতিদিনই শোনা যায় হতাশার গল্প। অনেকেই বলেন, চিকিৎসার মতো জরুরি বিষয়েও যদি ভুয়া কাগজের ব্যবসা চলে, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
দ্রুত প্রশাসনিক নজরদারি, কঠোর আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা ছাড়া এই প্রতারণা ঠেকানো যাবে না, এমনটাই মত সংশ্লিষ্টদের।