
ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ থেকে শিক্ষা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ তৈরিতে মন দিয়েছে ভারত। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই মারণাস্ত্র বাহিনীর হাতে এলে আমেরিকা এবং চিনের মতো ‘সুপার পাওয়ার’দের সঙ্গে একাসনে বসবে নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়, তখন মাটির গভীরে ‘সুরক্ষিত কামরা’য় লুকিয়েও নিস্তার পাবে না শত্রু। তাই এই খবরে ঘুম উড়েছে ইসলামাবাদ ও বেজিঙের।
ভারতীয় সেনাকে নতুন প্রজন্মের হাতিয়ারে সাজিয়ে তুলতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নির্মাণে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে দেশীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। সূত্রের খবর, অগ্নি-৫ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএমের (ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) একটি নতুন সংস্করণ তৈরি করছে তারা। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি ভূগর্ভের গভীরে ঢুকে হামলা করতে সক্ষম হবে বলে জানা গিয়েছে।
বছর কয়েক আগে অগ্নি-৫ আইসিবিএমের সফল পরীক্ষা করে ভারত। পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম সেই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি বলে জানিয়ে দেয় ডিআরডিও। তবে এর নতুন সংস্করণটি অবশ্য আণবিক হামলা চালাতে পারবে না। ৭,৫০০ কেজি ওজনের প্রচলিত বিস্ফোরক (পড়ুন কনভেনশনাল ওয়ারহেড) বোঝাই ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নিয়ে উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় আক্রমণ শানাতে পারবে অগ্নি-৫।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, বিস্ফোরণের আগে মাটির গভীরে থাকা বাঙ্কারের পুরু কংক্রিটের চাদর কেটে ৮০ থেকে ১০০ মিটার ভিতরে ঢুকে যাবে নতুন যুগের অগ্নি-৫। এর পর ঘটবে বিস্ফোরণ। ফলে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে কারও পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট ‘বাঙ্কার বাস্টার’ ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ২,৫০০ কিলোমিটার হতে যাচ্ছে বলে ডিআরডিও সূত্রে মিলেছে ইঙ্গিত।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা এ-হেন অত্যাধুনিক হাতিয়ার তৈরিতে নজর দেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে হইচই। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা জিবিইউ-৫৭ এমওপি-র (ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স পেনিট্রেটর) তুলনা টানা শুরু করে দিয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চলতি বছরের ২২ জুন ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট বোমাটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আমেরিকার বিমানবাহিনী। তার পরেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি নয় যুযুধান দু’পক্ষ।
বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য মনে করেন এই তুলনা টানা উচিত নয়। কারণ, মার্কিন জিবিইউ-৫৭ বোমা এবং ভারতের অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের মধ্যে বেশ কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। জিবিইউ-৫৭কে আমেরিকার কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ থেকে নিক্ষেপ করতে হয়। ফলে আলাদা করে এর পাল্লা বলা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, ভূমিতে বসানো লঞ্চারের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারবে নয়াদিল্লির অগ্নি-৫।
জিবিইউ-৫৭ আমেরিকার অস্ত্রভান্ডারের সবচেয়ে শক্তিশালী অ-পরমাণু বোমা হিসাবে স্বীকৃত। মাটির ২০০ ফুট নীচে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে তা ধুলিসাৎ করতে পারে এই মারণাস্ত্র। এক একটি মার্কিন ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার ওজন ১৩ হাজার ৬০৭ কিলোগ্রাম। সে দিক থেকে অগ্নি-৫ অনেকটাই হালকা। দু’টি হাতিয়ারের ওজনের পার্থক্য প্রায় ৬,১০০ কেজি।
আমেরিকার জিবিইউ-৫৭ ‘বাঙ্কার বাস্টার’ মোড়া থাকে শক্তিশালী এবং অতি-সহনশীল ইস্পাতের আবরণে। সেই কারণে পাথর বা কংক্রিটের তৈরি ভূগর্ভস্থ কোনও পরিকাঠামোকে এর সাহায্যে অনায়াসে ধ্বংস করা যায়। জিবিইউ-৫৭তে থাকে ২,৪০০ কেজির প্রচলিত বিস্ফোরক। বোমাটির দৈর্ঘ্য ২০.৭ ফুট। পাশাপাশি এটি জিপিএস গাইডেড বলে জানিয়েছে আমেরিকার বায়ুসেনা।
ভারতের অগ্নি-৫-এ যে প্রচলিত বিস্ফোরকগুলি থাকবে, সেগুলির ওজন আট টন পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একসঙ্গে একাধিক ওয়ারহেড নিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি উড়তে পারবে কি না, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণটি গতির নিরিখে ক্ষেপণাস্ত্রটি অনায়াসেই জিবিইউ-৫৭কে টেক্কা দেবে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণটিকে ‘হাইপারসনিক’ (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল) ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ৮ থেকে ২০ ম্যাক। অর্থাৎ, শব্দের আট থেকে ২০ গুণ গতিতে ছুটতে পারবে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ অগ্নি-৫। সেখানে আমেরিকার জিবিইউ-৫৭র গতিবেগ মাত্র এক ম্যাক। অর্থাৎ, কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ ছাড়া একে শত্রুব্যূহে ফেলা সম্ভব নয়।
আমেরিকার পাশাপাশি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ মারণাস্ত্র রয়েছে চিনের হাতেও। বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ এর জন্য ব্যবহার করে ডিএফ-১৫সি নামের স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের মতো এটিকেও ভূমিতে বসানো লঞ্চারের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করতে হয়।
ড্রাগন ফৌজের ডিএফ-১৫সি ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা মাত্র ৭০০ কিলোমিটার। ছয় থেকে আট ম্যাক গতিতে ছুটতে পারে এই মারণাস্ত্র। ২৫ মিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পুরু কংক্রিটের চাদর কেটে ভিতরে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট ডিএফ-১৫সির। ক্ষেপণাস্ত্রটির ওজন ৫০০ থেকে ৭০০ কেজি বলে জানা গিয়েছে।
গত ১৬ জুন বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির আণবিক অস্ত্রের আনুমানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা সিপ্রি। সেখানে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ১০০টি করে নতুন পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বাহিনীতে শামিল করছে চিন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছে বেজিং। এর জেরে বর্তমানে ড্রাগনভূমির পিএলএ-র অস্ত্রাগারে আণবিক হাতিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পরমাণু ‘ওয়ারহেড’-এর থেকেও পিএলএ-র আইসিবিএম সাইলো নিয়ে বেশি মাথাব্যথা রয়েছে ভারত ও আমেরিকার। সিপ্রি জানিয়েছে, উত্তর চিনের মরুভূমির মধ্যে তিন জায়গা এবং পূর্বের পাহাড়ি এলাকা জুড়ে একের পর এক এই সাইলো তৈরি করছে বেজিঙের লালফৌজ। চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা ৩৫০ ছাপিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় এগুলি থেকে আক্রমণ শানিয়ে ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে ড্রাগন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ যুক্ত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে কখনওই আর পাঁচটা হাতিয়ারের মতো সেনাছাউনির অস্ত্রাগারে রাখা হয় না। ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে বিশেষ ভাবে এগুলিকে সাজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। সেখানে বিশেষ ভাবে তৈরি উল্লম্ব লঞ্চার রেখেছে চিন। ফলে যুদ্ধের সময় ‘পাতালপুরী’ থেকে পরমাণু হামলা চালাতে পারবে বেজিং। এই ধরনের লঞ্চারগুলিকেই বাহিনীর পরিভাষায় বলা হয় আইসিবিএম সাইলো।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চিনের দেখাদেখি পরমাণু বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র লুকিয়ে রাখতে বেশ কিছু সাইলো তৈরি করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মূলত, বালোচিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে সেই সমস্ত ভূগর্ভস্থ ‘বাঙ্কার’। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুদ্ধের সময়ে সংশ্লিষ্ট সাইলোগুলিকে আগেই গুঁড়িয়ে দিতে অগ্নি-৫-এর মতো অতি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে ডিআরডিও। যদিও বাহিনীতে এটি কবে নাগাদ শামিল হবে, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে জিবিইউ-৫৭ বোমা ফেলে হামলা চালায় মার্কিন বায়ুসেনা। তাঁদের ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, এর ফলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে ফোরডো, নাতান্জ় ও ইসফাহানের আণবিক কেন্দ্র। পাশাপাশি, সমৃদ্ধ (পড়ুন এনরিচ্ড) ইউরেনিয়াম নষ্ট হওয়ায় পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা হারিয়েছে তেহরান। যদিও তাঁর দাবি ঘিরে বিশেষজ্ঞ মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গত ৯ থেকে ১২ মে পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চলাকালীন প্রাণভয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। এ ছাড়া জুন মাসে ১২ দিন ধরে চলা ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের সময়েও একই ছবি প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। লড়াই তীব্র হতেই শিয়া ধর্মগুরু তথা দেশের সর্বোচ্চ নেতা (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে নিয়ে যায় তেহরানের বাহিনী।
গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ মারফত এই খবর মেলার পর তৎপর হয় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। কিন্তু ইহুদিদের হাতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা না থাকায় আলি খামেনেইয়ের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তাঁরা। অন্য দিকে, চাপ দিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে নিকেশ করার অভিযানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয় তেল আভিভ। এই সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ভারতীয় সেনাকে নতুন প্রজন্মের হাতিয়ারে সাজিয়ে তুলতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নির্মাণে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে দেশীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। সূত্রের খবর, অগ্নি-৫ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএমের (ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) একটি নতুন সংস্করণ তৈরি করছে তারা। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি ভূগর্ভের গভীরে ঢুকে হামলা করতে সক্ষম হবে বলে জানা গিয়েছে।
বছর কয়েক আগে অগ্নি-৫ আইসিবিএমের সফল পরীক্ষা করে ভারত। পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম সেই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি বলে জানিয়ে দেয় ডিআরডিও। তবে এর নতুন সংস্করণটি অবশ্য আণবিক হামলা চালাতে পারবে না। ৭,৫০০ কেজি ওজনের প্রচলিত বিস্ফোরক (পড়ুন কনভেনশনাল ওয়ারহেড) বোঝাই ‘বাঙ্কার বাস্টার’ নিয়ে উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় আক্রমণ শানাতে পারবে অগ্নি-৫।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, বিস্ফোরণের আগে মাটির গভীরে থাকা বাঙ্কারের পুরু কংক্রিটের চাদর কেটে ৮০ থেকে ১০০ মিটার ভিতরে ঢুকে যাবে নতুন যুগের অগ্নি-৫। এর পর ঘটবে বিস্ফোরণ। ফলে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে কারও পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট ‘বাঙ্কার বাস্টার’ ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ২,৫০০ কিলোমিটার হতে যাচ্ছে বলে ডিআরডিও সূত্রে মিলেছে ইঙ্গিত।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা এ-হেন অত্যাধুনিক হাতিয়ার তৈরিতে নজর দেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে হইচই। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা জিবিইউ-৫৭ এমওপি-র (ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স পেনিট্রেটর) তুলনা টানা শুরু করে দিয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চলতি বছরের ২২ জুন ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট বোমাটি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আমেরিকার বিমানবাহিনী। তার পরেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি নয় যুযুধান দু’পক্ষ।
বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য মনে করেন এই তুলনা টানা উচিত নয়। কারণ, মার্কিন জিবিইউ-৫৭ বোমা এবং ভারতের অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের মধ্যে বেশ কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। জিবিইউ-৫৭কে আমেরিকার কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ থেকে নিক্ষেপ করতে হয়। ফলে আলাদা করে এর পাল্লা বলা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, ভূমিতে বসানো লঞ্চারের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারবে নয়াদিল্লির অগ্নি-৫।
জিবিইউ-৫৭ আমেরিকার অস্ত্রভান্ডারের সবচেয়ে শক্তিশালী অ-পরমাণু বোমা হিসাবে স্বীকৃত। মাটির ২০০ ফুট নীচে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে তা ধুলিসাৎ করতে পারে এই মারণাস্ত্র। এক একটি মার্কিন ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার ওজন ১৩ হাজার ৬০৭ কিলোগ্রাম। সে দিক থেকে অগ্নি-৫ অনেকটাই হালকা। দু’টি হাতিয়ারের ওজনের পার্থক্য প্রায় ৬,১০০ কেজি।
আমেরিকার জিবিইউ-৫৭ ‘বাঙ্কার বাস্টার’ মোড়া থাকে শক্তিশালী এবং অতি-সহনশীল ইস্পাতের আবরণে। সেই কারণে পাথর বা কংক্রিটের তৈরি ভূগর্ভস্থ কোনও পরিকাঠামোকে এর সাহায্যে অনায়াসে ধ্বংস করা যায়। জিবিইউ-৫৭তে থাকে ২,৪০০ কেজির প্রচলিত বিস্ফোরক। বোমাটির দৈর্ঘ্য ২০.৭ ফুট। পাশাপাশি এটি জিপিএস গাইডেড বলে জানিয়েছে আমেরিকার বায়ুসেনা।
ভারতের অগ্নি-৫-এ যে প্রচলিত বিস্ফোরকগুলি থাকবে, সেগুলির ওজন আট টন পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একসঙ্গে একাধিক ওয়ারহেড নিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি উড়তে পারবে কি না, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণটি গতির নিরিখে ক্ষেপণাস্ত্রটি অনায়াসেই জিবিইউ-৫৭কে টেক্কা দেবে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণটিকে ‘হাইপারসনিক’ (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল) ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ৮ থেকে ২০ ম্যাক। অর্থাৎ, শব্দের আট থেকে ২০ গুণ গতিতে ছুটতে পারবে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ অগ্নি-৫। সেখানে আমেরিকার জিবিইউ-৫৭র গতিবেগ মাত্র এক ম্যাক। অর্থাৎ, কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ ছাড়া একে শত্রুব্যূহে ফেলা সম্ভব নয়।
আমেরিকার পাশাপাশি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ মারণাস্ত্র রয়েছে চিনের হাতেও। বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ এর জন্য ব্যবহার করে ডিএফ-১৫সি নামের স্বল্পপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। অগ্নি-৫-এর নতুন সংস্করণের মতো এটিকেও ভূমিতে বসানো লঞ্চারের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করতে হয়।
ড্রাগন ফৌজের ডিএফ-১৫সি ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা মাত্র ৭০০ কিলোমিটার। ছয় থেকে আট ম্যাক গতিতে ছুটতে পারে এই মারণাস্ত্র। ২৫ মিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পুরু কংক্রিটের চাদর কেটে ভিতরে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট ডিএফ-১৫সির। ক্ষেপণাস্ত্রটির ওজন ৫০০ থেকে ৭০০ কেজি বলে জানা গিয়েছে।
গত ১৬ জুন বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির আণবিক অস্ত্রের আনুমানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা সিপ্রি। সেখানে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ১০০টি করে নতুন পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বাহিনীতে শামিল করছে চিন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছে বেজিং। এর জেরে বর্তমানে ড্রাগনভূমির পিএলএ-র অস্ত্রাগারে আণবিক হাতিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পরমাণু ‘ওয়ারহেড’-এর থেকেও পিএলএ-র আইসিবিএম সাইলো নিয়ে বেশি মাথাব্যথা রয়েছে ভারত ও আমেরিকার। সিপ্রি জানিয়েছে, উত্তর চিনের মরুভূমির মধ্যে তিন জায়গা এবং পূর্বের পাহাড়ি এলাকা জুড়ে একের পর এক এই সাইলো তৈরি করছে বেজিঙের লালফৌজ। চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা ৩৫০ ছাপিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় এগুলি থেকে আক্রমণ শানিয়ে ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে ড্রাগন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ যুক্ত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে কখনওই আর পাঁচটা হাতিয়ারের মতো সেনাছাউনির অস্ত্রাগারে রাখা হয় না। ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে বিশেষ ভাবে এগুলিকে সাজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। সেখানে বিশেষ ভাবে তৈরি উল্লম্ব লঞ্চার রেখেছে চিন। ফলে যুদ্ধের সময় ‘পাতালপুরী’ থেকে পরমাণু হামলা চালাতে পারবে বেজিং। এই ধরনের লঞ্চারগুলিকেই বাহিনীর পরিভাষায় বলা হয় আইসিবিএম সাইলো।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চিনের দেখাদেখি পরমাণু বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র লুকিয়ে রাখতে বেশ কিছু সাইলো তৈরি করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মূলত, বালোচিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে সেই সমস্ত ভূগর্ভস্থ ‘বাঙ্কার’। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুদ্ধের সময়ে সংশ্লিষ্ট সাইলোগুলিকে আগেই গুঁড়িয়ে দিতে অগ্নি-৫-এর মতো অতি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে ডিআরডিও। যদিও বাহিনীতে এটি কবে নাগাদ শামিল হবে, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে জিবিইউ-৫৭ বোমা ফেলে হামলা চালায় মার্কিন বায়ুসেনা। তাঁদের ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, এর ফলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে ফোরডো, নাতান্জ় ও ইসফাহানের আণবিক কেন্দ্র। পাশাপাশি, সমৃদ্ধ (পড়ুন এনরিচ্ড) ইউরেনিয়াম নষ্ট হওয়ায় পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা হারিয়েছে তেহরান। যদিও তাঁর দাবি ঘিরে বিশেষজ্ঞ মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গত ৯ থেকে ১২ মে পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চলাকালীন প্রাণভয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। এ ছাড়া জুন মাসে ১২ দিন ধরে চলা ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের সময়েও একই ছবি প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। লড়াই তীব্র হতেই শিয়া ধর্মগুরু তথা দেশের সর্বোচ্চ নেতা (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে নিয়ে যায় তেহরানের বাহিনী।
গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ মারফত এই খবর মেলার পর তৎপর হয় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। কিন্তু ইহুদিদের হাতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা না থাকায় আলি খামেনেইয়ের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তাঁরা। অন্য দিকে, চাপ দিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে নিকেশ করার অভিযানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয় তেল আভিভ। এই সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও, বলছেন বিশ্লেষকেরা।