রাজশাহীর বিদ্যালয়গুলো ভুগছে শিক্ষার্থী সংকটে

আপলোড সময় : ২৭-০৭-২০২৫ ০৭:৫৭:৪২ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২৭-০৭-২০২৫ ০৭:৫৭:৪২ অপরাহ্ন
এ বছর রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে ১২টি বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ১০ জনের নিচে। আবার কোনো বিদ্যালয়ে একজন পরীক্ষার্থীও অংশ নিয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে রাজশাহীর বেশ কিছু বিদ্যালয়।  

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলার এসব বিদ্যালয়ের মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৪ জন। এর মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছে ৩০ জন পরীক্ষার্থী। আর পাস করেছে ৪৪ জন। মফস্বল এলাকার বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে কমপক্ষে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী থাকার বিধান থাকলেও তা চোখে পড়ে না।

শিক্ষকরা বলছেন, বাল্যবিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখি করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে উদাসীনতা রয়েছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের। শিক্ষাবোর্ড সূত্র বলছে, এ বছর রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ২ হাজার ৬৯০টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেয়। শতভাগ পাস করেছে এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৯টি।

বিদ্যালয়গুলোর এসএসসির ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট পাসের হার ৫৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে গার্লস স্কুলগুলোর পাসের হার (ছাত্রী) ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মডেল স্কুলগুলোর ছাত্রদের পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের পাসের হার বেশি।

রাজশাহী নগরীর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পূর্বের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষার্থী কম প্রায় ৭০ভাগ। এক প্রকার স্কুলটি ফাঁকাই দেখা যায়। এছাড়াও রাণীনগর ণৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রী হাতে গুনা কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলটিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়মিত স্কুলে আসেন না। অন্যান্য শিক্ষকরা স্কুলে আসলেও ছাত্র/ছাত্রী না থাকায় স্কুলের বাইরে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা আর গল্প করে সময় পার করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, স্কুলটিতে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যার চেয়ে শিক্ষক স্টাফদের সংখ্যাই বেশি। এই স্কুলের সাবেক সভাপতি (২৪নং ওয়ার্ড) সাবেক আওয়ামী সভাপতি মোঃ আব্দুল করিম। তিনি বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগ বানিজ্য, শিক্ষকদের মারধর-সহ একক অধিপত্য বিস্তার করেছেন। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষক স্কুলটিতে তেমন নেই। তাছাড়া তারই আর্শিবাদে যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি এবং তার ভাই ক্রিড়া শিক্ষক এবং শিক্ষক রোকোনুজ্জামান রোকন স্কুলটির নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে অভিযোগ। স্কুলটিতে শুধুই রাজনীতি। শিক্ষার্থী হাতেগুণা, পাঠদান শূণ্য। এ ব্যপারে জানতে স্কুলটির সভাপতির মুঠোফোনে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।  

রাজশাহী নগরীর বিনোপুর এলাকায় রয়েছে সায়রা খাতুন গার্লস হাই স্কুল। এই স্কুলটিতেও শিক্ষার্থীদের অভাব। স্কুলটি থেকে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ৬জন শিক্ষার্থী। শতভাগ পাস করা স্কুলটিতে নিয়ে প্রধান শিক্ষকের মুঠোফোনে কল করা হলে বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধোরসা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি গত বছরও (২০২৪) একজন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে বছর ওই পরীক্ষার্থী ফেল করে। ফলে বিদ্যালয়টির শতভাগ ফেলের তালিকায় নাম আসে। এ বছরও একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফল আসে পাস। এতে করে এক পরীক্ষার্থী পাঠিয়ে শতভাগ পাসের তালিকায় স্থান পায় বিদ্যালয়টি। আর পরীক্ষায় অংশ নেয় পরীক্ষার্থী পেয়েছে জিপিএ ২.২৮।

অপরদিকে, এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া স্কুলগুলোর মধ্যে আটটি গার্লস স্কুল। এসব গার্লস স্কুল থেকে ৫৫ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩১ জন পাস করেছে। এছাড়া ২৪ জন ফেল করেছে। তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মডেল স্কুল থেকে ১৯ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এরমধ্যে ১৩ জন পাস করেছে। ফেল করেছে ৬ পরীক্ষার্থী। শুধুমাত্রা সরেরহাট গার্লস হাই স্কুল থেকে এক ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাকি স্কুলগুলোর পরীক্ষার্থীরা বিভিন্ন গ্রেডে পাস করেছেন।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের প্রকাশিত ফলাফল সূত্রে জানা গেছে, শারেরহাট গার্লস হাই স্কুল থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ৮ জন অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। স্কুলটি থেকে একজন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এমএইচ গার্লস হাই স্কুল থেকে ৬ জনের মধ্যে ৫ জন ফেল করেছে। জটনোশি গার্লস হাই স্কুল থেকে ৯ জনের মধ্যে ৫ জন ফেল করেছে। বানিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫ জনের মধ্যে ৪ জন ফেল করেছে। কোয়ালিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১০ জনের মধ্যে ২ জন ফেল করেছে। সায়রা খাতুন গার্লস হাই স্কুল থেকে পরীক্ষায় ৬ জন অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে। বঙ্গবন্ধু মোয়ার গার্লস হাই স্কুল থেকে ৫ জনের মধ্যে একজন ফেল করেছে। সিরাজ উদ্দিন সাহা গার্লস হাই স্কুল থেকে ৮ জনের মধ্যে ৬ জন ফেল করেছে। জুগিশো চাইনিকা গার্লস হাই স্কুল থেকে ৬ জনের মধ্যে একজন ফেল করেছে। পাকড়ী গার্লস হাই স্কুল থেকে ৭ জনের মধ্যে ৬ জন ফেল করেছে। ধোরসা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে। এছাড়া বিয়াম মডেল স্কুল, রাজশাহী থেকে তিনজন অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে।

ধোরসা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ইমন হোসেন বলেন, তিনি ২০১৫ সালে স্কুলটিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছেন। তারপরে পাশের গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি বলেন, এখানে পড়াশোনার মান ভালো ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন বেতন না হওয়ার কারণে শিক্ষকরা ঠিকমত স্কুলে আসতেন না। এরফলে তার সহপাঠীরা অন্য স্কুলে ভর্তি হলে তিনিও চলে যান।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ধোরসা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের দুইটি টিনশড ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। আর একটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তবে জানালা দিয়ে দেখা গেছে স্কুলের ক্লাস রুমের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বেঞ্চ।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু স্কুলের। প্রথম অবস্থায় সব ক্লাসের ভালো শিক্ষার্থী ছিল। পরবর্তিতে আস্তে আস্তে শিক্ষার্থী কমে যায়। এছাড়া দীর্ঘদিন এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে শিক্ষকরা স্কুলে আসা কমিয়ে দেয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন- ‘অর্থ, সময় ও শ্রম। সবই দিয়েছি স্কুলের পেছনে। তবুও স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। এ বছর যে ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে তাকে ধরে বেধে পরীক্ষায় বসাতে হয়েছে। তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক শিক্ষককে রাখতে হয়েছিল। তবুও ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে যেতে চাইত না।

গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ী গার্লস হাই স্কুল। এই স্কুলটি থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ৭ জন অংশ নিয়ে ৬ জন ফেল করেছে। আর গত বছর (২০২৪) ১৩ জন পরীক্ষা দিয়ে ১২ জন পাস করে। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক এসএম আক্তার রিজভী বলেন, ‘পাঠদানের অনুমতি রয়েছে। তবে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি নেই। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৮০ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছে। আর দশম শ্রেণিতে ২৩ জন ছাত্রী।’ ক্লাসে শিক্ষার্থী ৩০ জনের কমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বছর একটু কম শিক্ষার্থী রয়েছে। আর এ বছর যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে।

শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গ্রাম এলাকায় মেয়েদের ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর বেশিরভাগ মেয়ে আর স্কুলে যায় না। আবার মেয়ের ইচ্ছা থাকলেও স্বামী পড়াশোনা করাতে চায় না। সব মিলে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। ছেলে শিক্ষাথীর ক্ষেত্রে এদেও একটি অংশ উপার্জনের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়। ফলে তাদেরও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আ.ন.ম. মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থী কম থাকলে পরীক্ষা অংশ নিতে পারবে। তবে তিন বছর পরপরে স্বীকৃতি নবায়ন হয় স্কুলের। শিক্ষার্থী কম থাকলে স্বীকৃতি নবায়ন প্রশ্নের মুখে পড়বে। অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে স্কুল তৈরি করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী সঙ্কটে ভোগে। আসলে স্কুলের দরকারই নেই। তবুও স্কুল হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না হলে শুধু বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে লাভ কী ?#

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]