স্কুল যাত্রায় তাদের চালকবিহীন ডিঙ্গি নৌকায় ভরসা

আপলোড সময় : ১৮-০৯-২০২৫ ০৫:৪৬:৩৬ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৮-০৯-২০২৫ ০৫:৪৬:৩৬ অপরাহ্ন
একটি মাত্র ডিঙ্গি নৌকা। নেই চালক। নৌকার দুপাশে শেকলের সঙ্গে বাধা লম্বা রশি। রশির এক মাথা শেকলে; অপর মাথা পাড়ের গাছের সঙ্গে বাধা। একইভাবে নৌকার দুপাড়েই বাধা। ১০০ গজ দৈর্ঘ্যের শিব নদীটি পার হলে নৌকায় চেপে টানতে হয় রশি। এমনভাবে দিনভর এলাকাবাসী ছাড়াও কয়েকশো শিক্ষার্থী পারাপার হয় এই নৌকায়। এমন পারাপারে নৌকা থেকে পানিতে শিশু শিক্ষার্থী পড়ে যাওয়ার ঘটনা বিরল কিছু না বলছেন- অভিভাবকরা।

তারা বলছেন- এখানে নৌকা পারাপাড়ের রশিতে বেধে শিক্ষার্থীরা নদীতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিত্য দিনের ঘটনা। সর্বশেষ গতকাল (বুধবার ১৭ সেপ্টম্বর) তৃতীয় শ্রেণির একছাত্র নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। তখন অন্য সহপাঠীরা তার হাত ধরে ফেলে। পরে মানুষ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। সন্তানকে স্কুলে পাঠানো নিয়ে আমাদের মধ্যে একধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করে।

বুধবার (১৮ সেপ্টম্বর) সকাল সাড়ে  সাতটার দিকে মোহনপুর উপজেলা কেশরহাট পৌসভার নওগাঁ গ্রামের শিব নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। এসময় নৌকাতে নদী পারাপারের সময় কথা হয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাললের ছাত্র ফারুকের সঙ্গে। তিনিসহ আরও ছয়জন উঠেছেন এই নৌকায়। সঙ্গে তাদের স্কুলের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার।  

স্কুল ছাত্র ফারুক বলেন- ‘একা একা নৌকায় উঠে নদী পাড় হতে ভয় লাগে। মাঝে গিয়ে স্রোতে নৌকায় পূর্বদিকে চলে যায়। তখন রশি টেনে পাড়ে আসতে কষ্ট হয়। সকালে প্রাইভেটের জন্য আব্বা (বাবা) নদী পাড় করে দেয়। প্রাইভেট শেষে নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অনেক সময় মা আসে। বেশির ভাগ সময় এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে নদীপাড় হয়। বুধবার (১৭ সেপ্টম্বর) আমাদের ক্লাসের এক ছাত্র রশিতে বেধে নৌকা থেকে নদীতে পাড়ে যায়।’

শিক্ষার্থী সম্পা খাতুন বলেন, এই নদীতে সময় পানি থাকে। সবসময় নৌকায় পাড় হতে হয়। বৃষ্টির সময় পাড় থেকে নদীতে নামতে গিয়ে পড়ে যাই। অনেকে নৌকা থেকেও পড়ে যায়। বই-খাতা ভিজে যায়। তখন আমাদের পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়।

নদীতে তেমন স্রোত না থাকলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পারাপারে ঝুকির কথা উল্লেখ করে স্কুলের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার বলেন- এখন স্রোত নেই। তবে কিছুদিন আগে ভালো স্রোত ছিল। সেই সময় ডিঙ্গি নৌকায় পারপার কষ্টকর হয়। আমরা বড় মানুষ নৌকা নিয়ে নদী পাড় হতে ভয় পায়। ছোট মানুষরা তো আরও ভয় পাবে। এখানে বাঁশের সাকো ছিল। সেটি ভেঙে গেছে। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ছাড়ায় চলাচলের সুবিধার জন্য এখানে ব্রিজ হলে হাজারও মানুষের ভোগান্তি কমবে।  

জানা গেছে- ১০০ গজ দৈর্ঘ্যের শিব নদী পরাপারের জন্য একসম ছিল বাঁশের সাকো। দীর্ঘদিনের সাকো ভেঙে যাওয়ায় পারাপারে মাত্র ভরসা ডিঙ্গি নৌকা। তাতে দিনভর শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ পারাপার হয়। নদী পাড়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা ছাড়াও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডিঙ্গি নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় বলছেন- শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকার মানুষ। শিব নদীর উত্তরে মালিদহ ও গোপইল গ্রাম। আর দক্ষিণে নওগাঁ গ্রাম। পাশাপাশি গ্রামে একটি মাধ্যমিক ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একটি ধাঁমিন নওগা নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় ও অপরটি নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১২০ বছরের পুরানো নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশেপাশের তিন গ্রামে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেয়। সঙ্গত কারণে শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়। তবে গেল কয়েক বছরে ২০০ থেকে কমে ১১৮ জন দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থী। বর্তমানে স্কুলটিতে ৬২ জন ছেলে ও ৫৬ জন মেয়ে পড়াশোনা করে।

বিদ্যালয়টির শিক্ষক বলছেন- বাঁশের সাকো থাকা অবস্থাতেও স্কুলে ২০০ বেশি শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু বাশের সাকোটা ভেঙে যাওয়ার পরে নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী পাঠায় না অভিভাবকরা। অভিবাকরা শিক্ষকদের জানায়- নদী পার হতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা পানিতে পাড়ে যায়। প্রাণহানীর ঝুঁকি থাকায় তারা দূরের স্কুলের ভর্তি করেছে ছেলে-মেয়েকে।

শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরেসা বেগম বলেন, স্কুলের শিক্ষক, পিয়ন নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা নৌকায় বাধা রশি টেনে ছাত্র-ছাত্রীদের পার করে নেয়। গতকাল (বুধবার ১৭ সেপ্টম্বর) চতুর্থ শ্রেণির একছাত্র নদীতে পড়ে যায়। তখন অন্যসহপাঠীরা তাকে পানিতে ধরে ফেলে। পরে মানুষ গিয়ে তাকে পাড়ে নিয়ে আসে। আমাদের সবসময় মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা নিয়ে থাকতে হয় ছেলে-মেয়ের স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসা নিয়ে।

অভিভাবক শহিদুল ইসলাম বলেন,  সকালে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নদী পাড় করে দিতে হয়। আবার দুপুরে টিফিনের সময় বাড়ির কাজ ফেলে এসে নদীপাড়ে বসে থাকতে হয়। একইভাবে বিকেলে ছুটির সময় নদীপাড়ে অপেক্ষায় থাকি। ছেলে-মেয়ে আসলে তাদের নদী পাড় করে নেয়। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নদীপাড় করে দেয়। স্কুল যেতে এই নদী পারাপারের কারণে অনেকেই অন্য স্কুলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন। এই স্কুলটা কাছে হয়। আর পড়াশোনা ভালো। তাই এখানেই রেখেছি মেয়েকে। আমাদের দাবি- এখানে একটা ব্রিজ হলে চার-পাঁচ গ্রামের মানুষের উপকার হবে। কেশরহাটের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে। ফলে ছেলে-মেয়েরা তিন থেকে চার কিলো পথ না ঘুরে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।

নদীতে মাছ শিকার করছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মুঞ্জিলা সরদার। তিনি বলেন- নদী পারাপারে বাঁশের সাকো ছিল। সেটি ভেঙে গেছে। এখন একটা ছোট ডিগ্রি নৌকায় স্কুলে যাতায়াত করে ছাত্র-ছাত্রীরা। অনেক সময় নদীতে পড়েও যায় মানুষ। এখানে একটা ব্রিজ হলে অনেক মানুষের উপকার হবে। চার থেকে পাঁচ গ্রামের মানুষের যাতায়ত সুবিধা হবে। নদীতে বেশি পানি থাকলে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ ঘুরে স্কুলে আসে। এতে তাদের কষ্ট হয়।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মোস্তফা আহমেদ বলেন, প্রতিদিন নদী পাড় হয়ে ৫৫ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী আমার স্কুলে আসে। তারা ছোট ছোট মানুষ। নদী পারাপার নিয়ে আমাদের ভয় লাগে। কখন কি হয়ে যায়। আমাদের অফিসসহকারী রাজুকে সকাল ও বিকেলে স্কুল ছুটির সময় নদীপাড়ে পাঠানো হয়। সে শিক্ষার্থীদের পারাপারে সহযোগিতা করে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও আসে নদীপাড়ে। তারা অনেক সময় তাদের সন্তানদের নদী পাড় করিয়ে নিয়ে যায়। মালিদহ ও গোপইল গ্রামের বেশি শিক্ষার্থী নদী পার হয়ে আসে। ডিঙি নৌকায় চড়ে তারা ভয় পায়।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র নদী পারাপারকে কেন্দ্র করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী কমে গেছে। কয়েক বছর আগেও ২০০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রী ছিল। প্রায় ৮০ জনের মত কমে গেছে। একটাই কারণ নদী। এই কারণে শিক্ষার্থীদের অভিভাকরা আমাদের বলেন- আপনার স্কুলে ছেলে-মেয়েকে পাঠাতে নদী পার হতে হয়। এতে করে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এমন দুর্ঘটনার সঙ্কায় তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে দূরের স্কুলে ভর্তি করেছে। তারা সরাসরি বলে- এখানে ব্রিজ হলে ছেলে-মেয়েদের যাতাযাতে সমস্যা হবে না। তখন স্কুলে ছেলে-মেয়েকে পাঠানো হবে।

বিষয়টি নিয়ে রাজশাহী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মুঠোফোন কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তিতে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) লিয়াকত সালমানের মুঠোফোন কল করা হলেও তিনিও রিসিভ করেনি। আর এলাকাটি কেশরহাট পৌরসভার মধ্যে হলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে নেই মেয়র। তাই এবিষয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]