একাধিক পরকীয়া, নিজের ছেলেকে ‘খুন’!


আন্তর্জাতিক ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 06-10-2022

একাধিক পরকীয়া, নিজের ছেলেকে ‘খুন’!

‘দিদ্দা’। এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই কাশ্মীরের এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের চোখে ছায়া পড়ে আতঙ্কের। কানের কাছে ফিসফিস করে ট্যুরিস্ট গাইড পর্যটকদের শোনান এক ‘প্রেতসিদ্ধা’ রানির কাহিনি। খ্রিস্টীয় দশম শতকের এই রানিকে ঘিরে আজও পল্লবিত রয়েছে প্রাকৃত-অপ্রাকৃত নানা কাহিনি। কিংবদন্তি ঘিরে ফেললেও কাশ্মীরের ইতিহাসে কিন্তু দিদ্দা রানির অস্তিত্ব সত্যিই ছিল। ৯৮০ থেকে ১০০৩ খিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কাশ্মীরের সিংহাসন সামলেছিলেন। কখনও তাঁর ছেলের হয়ে, কখনও বা নাতিদের হয়ে আবার কখনও একেবারে প্রত্যক্ষ ভাবেই ভূস্বর্গ শাসন করেছিলেন দিদ্দা।

দিদ্দা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায় কাশ্মীরের দ্বাদশ শতকীয় কবি কলহণের ‘রাজতরঙ্গিনী’ কাব্যে। ‘রাজতরঙ্গিনী’ আসলে কাব্যে রচিত কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত। কলহণ তাঁর রচনায় দিদ্দা সম্পর্কে খুব সদর্থক কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু দিদ্দা সম্পর্কে কিছু জানতে হলে কলহণের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কলহণের লেখায় অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাত ছিল। দিদ্দার কাহিনি লিখতে গিয়ে তাই তাঁকে খুব উজ্জ্বল আলোয় দেখাতে পারেননি কাশ্মীরের কবি ও কালপঞ্জি লেখক।

‘রাজতরঙ্গিনী’-র ইংরেজি অনুবাদক স্যর অরেল স্টাইন কিন্তু দিদ্দাকে ‘কাশ্মীরের ক্যাথরিন দ্য গ্রেট’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। প্রসঙ্গত, ক্যাথরিন দ্য গ্রেট বা দ্বিতীয় ক্যাথরিন ১৭৬২ থেকে ১৭৯৬ পর্যন্ত রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ছিলেন। তাঁর আমলে রাশিয়া এক নবযুগে পা রাখে। ক্যাথরিনের আমলেই রাশিয়ায় নতুন নগরায়ন শুরু হয়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে রাশিয়া প্রবল উন্নতি করে। ইতিহাসে ক্যাথরিন ‘জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরশাসক’ হিসেবে অমর হয়ে রয়েছেন।

খ্রিস্টীয় দশম শতকে কাশ্মীর ও পঞ্জাবের মধ্যবর্তী পিরপঞ্জাল পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ছোট-বড় বেশ কিছু শৈব রাজ্য। তার মধ্যে অন্যতম রাজ্য লোহার। সেখানকার সিংহ বংশীয় রাজার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন কাবুলের হিন্দু শাহির অধিপতি ভীমদেব। দিদ্দা সিংহ রাজারই সন্তান। কলহণ তাঁর রচনায় দিদ্দাকে ‘চরণহীনা’ বলেছেন। অনুমান, দিদ্দার পায়ে কোনও সমস্যা ছিল। সম্ভবত তিনি পোলিও-আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু শারীরিক ত্রুটি সত্ত্বেও দিদ্দা ছিলেন পরমাসুন্দরী।

অন্য দিকে ঝিলম নদীর তীরে কাশ্মীর তখন ছোট একটি রাজ্য। সেখানকার বালকরাজা সংগ্রামদেবকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছেন মন্ত্রী প্রভাগুপ্ত। প্রভাগুপ্তের ছেলে ক্ষেমাগুপ্ত ছিলেন দারুণ অত্যাচারী। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ব্যাভিচারে পূর্ণ। এই ক্ষেমাগুপ্তই দিদ্দাকে বিয়ে করে রাজধানী শ্রীনগরে নিয়ে আসেন। দিদ্দার বয়স তখন ২৬। ক্ষেমাগুপ্তের অন্য পত্নীরা দিদ্দাকে প্রথম থেকেই বিষ নজরে দেখলেন। আর রাজসভায় ঘনিয়ে উঠতে শুরু করল ক্ষেমাগুপ্ত-বিরোধী ষড়যন্ত্র।

অসামান্য বুদ্ধিমতী দিদ্দা বুঝতে পেরেছিলেন, বংশগৌরবহীন ক্ষেমাগুপ্ত শারীরিক ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁকে বিয়ে করেছেন ‘জাতে ওঠা’র জন্য। প্রথমেই রাজাকে তিনি বশীভূত করে ফেললেন। ক্ষেমাগুপ্ত দিদ্দার দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হয়ে পড়লেন যে, ‘দিদ্দাক্ষেমা’ নামে এক বিশেষ মুদ্রারও প্রচলন করে দিলেন। সেই সময় রাজ্যের মহামন্ত্রী ছিলেন ফাল্গুন। তিনিও তাঁর মেয়ে চন্দ্রলেখার সঙ্গে ক্ষেমাগুপ্তের বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দিদ্দার প্রভাবে চন্দ্রলেখা-সহ বাকি রানিরা অন্তরালে চলে যাওয়ায় ফাল্গুনও ‘দিদ্দা-ক্ষেমা’র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন।

ইতিমধ্যে ক্ষেমাগুপ্তের ঔরসে অভিমন্যু নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন দিদ্দা। ক্রমশ সকলেই বুঝতে পারলেন যে, ক্ষেমাগুপ্তের সিংহাসনের উত্তরাধিকার পেতে চলেছেন এই রাজপুত্রই। এর কিছু দিনের মধ্যেই শিকারে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্ষেমাগুপ্ত। এবং অকালেই মারা গেলেন তিনি।

অভিমন্যুর উত্তরাধিকার প্রতিহত করার জন্য কাশ্মীরের রাজসভায় তখন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে। দিদ্দা প্রথমেই তাঁর শিশুপুত্রকে লুকিয়ে ফেললেন। দিদ্দাকে ক্ষেমাগুপ্তের চিতায় তুলে সহমরণে বাধ্য করার চেষ্টা করলেন ষড়যন্ত্রীরা। দিদ্দা কঠোর ভাবে সেই সব চক্রান্ত দমন করে জানালেন, বালক রাজার অভিভাবিকা হিসেবে তাঁর বেঁচে থাকা জরুরি। অভিমন্যুর অভিষেক সম্পন্ন করে নিজেই এসে বসলেন দরবারে। ষড়যন্ত্রের মূল চক্রী মন্ত্রী ফাল্গুন ভয়ে দেশ ছেড়ে পালালেন।

অভিমন্যুকে হত্যার জন্য অনেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তখনও। দিদ্দা একা হাতে সেই সব ষড়যন্ত্র দমন করলেন। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য কখনও বা নিজে অস্ত্র ধরলেন। দরবারে নিজের পক্ষে অমাত্যদের টানতে তিনি প্রচুর ধনরত্ন উপহার দিলেন। একান্ত অবাধ্যদের গুপ্তঘাতক নিয়োগ করে হত্যা করতেও পিছপা হলেন না।

যত দিন যেতে লাগল, দিদ্দার ক্ষমতা তত বাড়তে শুরু করল। এক সময়ে তিনি প্রতিপক্ষের ত্রাস হয়ে দাঁড়ালেন। একের পর এক পুরুষকে নিজের রূপে বশীভূত করে ফেললেন। আশপাশের রাজ্যগুলিতেও তাঁর বিরোধী ষড়যন্ত্র দমন করতে শুরু করলেন। কথিত আছে মন্ত্রী নরবাহনকে নিজের রূপে মোহিত রেখে দিদ্দা নাকি তাঁকে দিয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নিতেন। উপত্যকায় গুঞ্জন ছড়াল, দিদ্দা জাদু জানেন। তিনি গুপ্ত শক্তির অধিকারিণী। এমন অবস্থায় মন্ত্রী নরবাহন আত্মহত্যা করলেন। লোকে বলতে লাগল, দিদ্দার নেকনজর সরে যেতেই ভয়ে মন্ত্রী আত্মঘাতী হয়েছেন।

নরবাহনের মৃত্যুর পরে লোহারদের চিরশত্রু শূদ্রবংশীয় দামারা গোষ্ঠী দিদ্দার রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। রানি দিদ্দা এক আশ্রম থেকে প্রাক্তন মন্ত্রী ফাল্গুনকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। সম্ভবত রানির সঙ্গে ফাল্গুন কোনও সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু এমন সময়েই রহস্যজনক ভাবে মারা গেলেন রাজা অভিমন্যু। গুজব রটে, নিজের মায়ের অবৈধ প্রণয় সহ্য করতে পারেননি তিনি। তাই আত্মহত্যা করেন। আবার কেউ কেউ বলতে থাকে, রানি দিদ্দাই ছেলেকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন।

অভিমন্যুর মৃত্যুর পরে দিদ্দা হিংস্র হয়ে ওঠেন। কাশ্মীরের বিহিন্ন জনপদে তখন তাঁকে নিয়ে গুজবের অন্ত নেই। রাতে কোথাও কেউ ষড়যন্ত্র করছে কি না দেখার জন্য নিজেই সরিসৃপের মতো বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়ান প্রাসাদের আনাচে-কানাচে। হাঁটতে পারতেন না, কিন্তু তিনি নাকি দেওয়াল বেয়ে অনায়াসে চলাফেরা করতে পারতেন। এই দৃশ্য দেখামাত্রই লোকের মৃত্যু হয়— এমন কথাও চাউর হয় কাশ্মীরের শহর-গ্রামে-প্রান্তরে। লোকে মনে করতে শুরু করে দিদ্দা প্রেতসিদ্ধা।

এর পরে আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় অভিমন্যুর শিশুপুত্র নন্দীগুপ্ত, ত্রিভুবনগুপ্তের। গুজব রটে, দিদ্দার বশীভূত অপদেবতাই নাকি ‘অবাধ্য’ রাজপুত্রদের হত্যা করছে। ৯৭৫ সালে কাশ্মীরের সিংহাসনে বসলেন অভিমন্যুর তৃতীয় পুত্র ভীমগুপ্ত। মন্ত্রী ফাল্গুনও মারা গিয়েছেন তত দিনে। রানি নাকি এক সুদর্শন মেষপালকের সঙ্গে তখন প্রণয়-খেলায় মত্ত। সেই মেষপালক তুঙ্গই নাকি রানির অনুগ্রহ পেয়ে রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছেন। ভীমগুপ্ত তাঁর বিরোধিতা করায় তাঁকেও নাকি হত্যা করা হয়।

কাশ্মীরের সিংহাসনে বসার মতো কোনও পুরুষ আর রাজবংশে সেই সময় ছিল না। রানি দিদ্দা এ বার নিজের হাতেই তুলে নিলেন শাসনভার। দীর্ঘ ২২ বছর তিনি একক ভাবে শাসন করেছেন কাশ্মীরকে। কলহণ নিজেই লিখেছেন, দিদ্দা নাকি ৭০টির মতো মঠ ও মন্দির নির্মাণ করান। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁকে ‘পিশাচসিদ্ধা’ বলে বর্ণনাও করেছেন কলহণ। ১০০৩ খ্রিস্টাব্দে দিদ্দার মৃত্যু হয়। কলহন ‘রাজতরঙ্গিনী’ লেখেন তার দেড়শো বছর পরে। তত দিনে কাশ্মীর উপত্যকার গণস্মৃতিতে দিদ্দাকে নিয়ে পল্লবিত হয়েছে অসংখ্য অলৌকিক কাহিনি। কলহণ সে সবের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে করেন আজকের ইতিহাসবিদরা।

যে ভাবে অগণিত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ইংল্যান্ডের সঙ্কট দূর করে শক্ত হাতে শাসন করেছিলেন রানি প্রথম এলিজাবেথ, যে ভাবে সুলতানা রাজিয়া রক্ষা করেছিলেন দিল্লির সুলতানি, কাশ্মীরের এক সঙ্কট সময়ে দিদ্দাও ঠিক সে ভাবেই শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন রাজ্যের। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহক ইতিবৃত্ত লেখক আর জনশ্রুতির রচয়িতারা এক নারীর শৌর্যকে মেনে নিতে পারেননি, তাই কি দিদ্দাকে ঘিরে এই সব ভঙ্কর কিংবদন্তির জন্ম?

দিদ্দার মৃত্যুর ১০ বছর পরে গজনির সুলতান মামুদ ভারতীয় ভূখণ্ড আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি কাশ্মীর দখল করতে ব্যর্থ হন। এর পিছনে কি কাজ করেছিল দিদ্দার হাতে তৈরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা?

আজও কাশ্মীরে শ্রদ্ধেয়া নারীদের ‘দেদ’ বা ‘দিদ্দা’ বলে সম্বোধন করা হয়। চতুর্দশ শতকের কাশ্মীরের মরমিয়া সাধিকা ও কবি লাল্লেশ্বরী বা লাল্লা প্রসিদ্ধা হয়ে রয়েছেন ‘লাল দেদ’ নামে। দিদ্দা যদি ‘অপশক্তি’র অধিকারিণীই হবেন, তা হলে কেন এমন সম্বোধন আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়?

আসলে দিদ্দার কাহিনি শারীরিক ভাবে অসমর্থ এক নারীর সংগ্রামের ইতিহাস। পুরুষের হাতে লেখা ইতিহাস তাকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে, ভয় পায়। কখন যে ‘হিস্ট্রি’ ‘হিজ স্টোরি’ থেকে ‘হার স্টোরি’-তে পরিণত হয়ে যায়, সে কারণে তো আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভীত থাকে। ইতিহাসে ঘটে সত্যের অপলাপ। ক্ষমতাময়ী নারীরা পরিণতি পান ‘ডাইনি’ বদনামে। যেমন ঘটেছিল পঞ্চদশ শতকের ফ্রান্সে জোয়ান অফ আর্কের ক্ষেত্রে। (ঋণস্বীকার: ‘কাশ্মীরের আতঙ্ক ছিলেন যে মহারানি’, চিরশ্রী মজুমদার)


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]