বিয়ের ক্ষেত্রে নবিজির (সা.) সুন্নাহ


ধর্ম ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 08-02-2023

বিয়ের ক্ষেত্রে নবিজির (সা.) সুন্নাহ

যে সমাজে বিয়ে সহজ হবে, সেই সমাজ ব্যভিচারমুক্ত হবে। পক্ষান্তরে যে সমাজে বিয়ে কঠিন হবে, সেই সমাজে ব্যভিচার সহজ হয়ে পড়বে। এজন্য বিয়ের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল সুন্নাহ হলো বিয়ে সহজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়েকে সহক করতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাহলো-

১. বিয়ের নিয়ত শুদ্ধ করা: নারী-পুরুষের উভয়ের উচিত বিয়ের মাধ্যমে নিজেকে হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর নিয়ত করা। তাহলে উভয়ে এর দ্বারা সাদাকার সওয়াব লাভ করবে। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

‘তোমাদের সবার স্ত্রীর যোনিতেও রয়েছে সাদকা। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমাদের কেউ কি তার জৈবিক চাহিদা মেটাবে আর তার জন্য সে কি নেকী লাভ করবে? তিনি বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো যদি সে ওই চাহিদা হারাম উপায়ে মেটাতো তাহলে তার জন্য কোনো গুনাহ হত না? (অবশ্যই হতো) অতএব তেমনি সে যখন তা হালাল উপায়ে মেটায়, তার জন্য নেকী লেখা হয়।’ (মুসলিম ১৬৭৪)

২. ইস্তিখারা করা: মুসলিম নর-নারীর জীবনে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই যখন তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের জন্য কর্তব্য হলো ইস্তিখারা তথা আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা। হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় সে যেন দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে অতপর বলে–

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ ، وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ ، وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي ، أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ – فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي ، أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ – فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي.

‘হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি।‌ কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ, এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উল্লেখ করবেন) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, জীবিকা ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অত:পর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন। (বুখারী ১১৬৬)

৩. পরামর্শ করা: বিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ, পাত্রী ও তার পরিবার সম্পর্কে ভালো জানাশুনা রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে অধিক পরিমাণে পরামর্শ করতেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অন্য কাউকে আপন সাথীদের সঙ্গে বেশি পরামর্শ করতে দেখিনি।’ (তিরমিজি ১৭১৪)

৪. সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিয়ের পয়গাম পাঠানো এবং কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেওয়া। হজরত জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَقَدَرَ عَلَى أَنْ يَرَى مِنْهَا مَا يُعْجِبُهُ وَيَدْعُوهُ إِلَيْهَا فَلْيَفْعَلْ. قَالَ جَابِرٌ : فَلَقَدْ خَطَبْتُ امْرَأَةً مِنْ بَنِى سَلِمَةَ فَكُنْتُ أَتَخَبَّأُ فِى أُصُولِ النَّخْلِ حَتَّى رَأَيْتُ مِنْهَا بَعْضَ مَا أَعْجَبَنِى فَتَزَوَّجْتُهَا

‘তোমাদের কেউ যখন নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, অতপর তার পক্ষে যদি ওই নারীর এতটুকু সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হয়, যা তাকে মুগ্ধ করে এবং মেয়েটিকে (বিবাহ করতে) উদ্বুদ্ধ করে, সে যেন তা দেখে নেয়।’ (বাইহাকি ১৩৮৬৯)

মনে রাখা জরুরি

আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নাতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২০০)

৫. বিয়ে হবে সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর। আবশ্যক হল, অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি, গান-বাদ্য, ভিডিও-অডিওমুক্ত বিয়ে হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا

‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৭)

৬. সামর্থ্যের অধিক মহরানার শর্ত না থাকা; বরং মহরানা সামর্থ্যানুযায়ী ধার্য করা। কেননা হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ مِنْ يُمْنِ الْمَرْأَةِ : تَيْسِيرَ خِطْبَتِهَا ، وَتَيْسِيرَ صَدَاقِهَا ، وَتَيْسِيرَ رَحِمِهَا

কনের বরকতের আলামত হচ্ছে- বিয়ের প্রস্তাবনা সহজ হওয়া, মোহরানা সহজসাধ্য হওয়া এবং গর্ভ ধারণ সহজ হওয়া। (মুসনাদে আহমাদ ২৩৯৫৭)

অন্যত্র নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, خَيْرُ الصَّدَاقِ أَيْسَرَه‘সর্বোত্তম মোহরানা হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা।’ (বাইহাকি ১৪৭২১)

৭. শাওয়াল মাসে বিয়ে সম্পাদন করা। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন-

تَزَوّجَنِي رَسُولُ اللهِ ﷺ فِي شَوّالٍ، وَبَنَى بِي فِي شَوّالٍ، فَأَيّ نِسَاءِ رَسُولِ اللهِ ﷺ كَانَ أَحْظَى عِنْدَهُ مِنِّي؟

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে শাওয়াল মাসেই বিয়ে করেছেন এবং শাওয়াল মাসেই আমার বাসর করেছেন। সুতরাং তার কাছে আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যবতী স্ত্রী আর কে আছে?’ (মুসলিম ১৪২৩)

উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে।

৮. বিয়ের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিয়ে করা এবং জুমার দিন মসজিদে (বিয়ে) সম্পাদন করা। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَعْلِنُوا هَذَا النِّكَاحَ وَاجْعَلُوهُ فِي الْمَسَاجِدِ

‘তোমরা এ বিয়ের ঘোষণা দাও এবং তা মসজিদে সম্পাদন কর।’ (তিরমিজি ১০৮৯)

৯. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো অভিনন্দনের মাধ্যমে বর-কনে পরস্পরকে অভিনন্দন জানানো। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, যখন কেউ বিয়ে করত তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুভেচ্ছা জানাতেন ও তাদের জন্য এই বলে দোয়া করতেন-

بَارَكَ اللَّهُ لَكَ ، وَبَارَكَ عَلَيْكَ ، وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِي خَيْرٍ

অর্থ : আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত ঢেলে দিন এবং তোমাদের দুইজনকে কল্যাণের ওপর একত্রিত করুন। (আবু দাউদ ২১৩০)

১০. ওয়ালিমা বা বৌভাত করা: বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমার আয়োজন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটি বিয়ের প্রচারণার অন্তর্ভুক্ত এবং আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করার শামিল।

হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আব্দুর রহমান বিন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বিয়ে করেছেন তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও তুমি ওয়ালিমার আয়োজন কর।’ (বুখারি ও মুসলিম)

উল্লেখ্য, ওয়ালিমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থ্যানুযায়ী খরচ করাই সুন্নাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওয়ালিমা শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত করা হয়, দীনদার ও গরীব-মিসকিনদের দাওয়াত করা হয় না, সে ওয়ালিমাকে হাদীসে নিকৃষ্টতম ওয়ালিমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের নিকৃষ্ট ওয়ালিমার আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত। (আবু দাউদ ৩৭৫৪)


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]