খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোডম্যাপ


অর্থনীতি ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 04-02-2024

খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোডম্যাপ

খেলাপি ঋণ আদায়ে অবলোপন নীতিমালা আরও শিথিল করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ঋণ তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর মন্দমানে খেলাপি হলেই তা অবলোপন করে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেওয়া যাবে। এ উপায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ কমানো হবে। পাশাপাশি আলাদা কোম্পানির কাছে অবলোপনকৃত ঋণ বিক্রি, এমডির কর্মমূল্যায়ন আদায়ে লক্ষ্য অর্জন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোরতা, ঋণ পরিশোধে আর নমনীয়তা না দেখানোর মতো বিভিন্ন প্রস্তাব অনুমোদন করেছে পরিচালনা পর্ষদ।

রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো এবং করপোরেট সুশাসন জোরদার বিষয়ে আলোচনায় সুনির্দিষ্ট ১১টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভাকক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্য পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অনুকূলে সরকার ইস্যু করা বন্ড জামানত রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারে হাসানা বা বিনা সুদে ধার, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অভিবাসন পুনর্বাসন বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যাংক রেট তথা ৪ শতাংশ সুদে ১ হাজার কোটি টাকার প্রাক অর্থায়ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফের শর্তের আলোকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। সংস্থাটির ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ওই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ পরিশোধ না করেও যে উপায়ে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা করা যাবে না। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২১ শমিক ৭০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৭ দশমিক শুন্য ৪ শতাংশ ঋণ খেলাপি। তবে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বা ডিসট্রেস অ্যাসেটের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে কাগজে কলমে ব্যাংক খাতের খেলাপি দেখানো হয়, ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। আইএমএফের শর্তের আলোকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি বা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পরিচালক পর্ষদের সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের সংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, খেলাপিদের ধরতে সব ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। তারা নতুন করে জমি, বাড়ি, গাড়ি কিনতে পারবে না। নতুন ব্যবসাও খুলতে পারবে না। ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত ঋণ, বেনামি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি অথবা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ প্রবণতা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের একটি ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দিয়েছে। কোনো ব্যাংক এর মধ্যে পড়লে আগামী বছর বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে যেসব ঋণখেলাপি ব্যাংকের পরিচালক আছেন, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোর্টের আদেশের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না।

খেলাপি কমাতে ১১ কর্মপরিকল্পনা: ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নিচে নামাতে মন্দঋণ অবলোপনের সময় ৩ বছর থেকে কমিয়ে ২ বছর করা হচ্ছে। এখনকার তুলনায় এতে খেলাপি কমবে ৪৩ হাজার ৩০ কোটি বা দুই দশমিক ৭৬ শতাংশ। এখনকার মতো শতভাগ প্রভিশন রেখে এসব ঋণ অবলোপন করতে হবে। এ ধরনের খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের এমডিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আলাদা একটি ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ করতে হবে। ব্যাংকের এমডির কর্মমূল্যায়নে এই ইউনিনের সফলতা বিবেচনা করা হবে। এ ধরনের ঋণ কেনার জন্য বেসরকারি এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইন করা হবে। এতে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট পরিস্কার হবে।

আদায় না হলেও বিভিন্ন উপায়ে নিয়মিত দেখানো ‘স্ট্রেস অ্যাসেট’র বিপরীতে আয় দেখানো যাবে না। কেবল প্রকৃত আদায়ের বিপরীতে ব্যাংক আয় দেখাতে পারবে। এছাড়া করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি শিথিলতায় পরিশোধ না করলেও খেলাপি হচ্ছে না। এতে করে ঋণ পরিশোধের প্রবাহ কমে তারল্য সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আগামীতে আর এই সুবিধা না দেওয়ায় নগদ প্রবাহ বেড়ে তারল্য সঙ্কট কমবে। বর্তমানে একটি মেয়াদি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ গণনার সময় ৬ মাস নির্ধারিত আছে। আন্তর্জাতিক চর্চার আলোকে এক্ষেত্রে আগের অন্য সব ঋণের মতো নিয়মে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরদিন থেকে হিসাব করা হবে। এছাড়া বর্তমানে অর্থ ঋণ আতালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। প্রতিটি ব্যাংকের আইন বিভাগকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এসব মামলা দ্রুত নিস্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।

রোডম্যাপে আরও বলা হয়েছে, ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। ইচ্ছৃকত খেলাপিদের নতুন জমি, বাড়ি গাড়ি কিনতে পারবে না। এমনকি নতুন ব্যবসাও খুলতে পারবেন না। আর খেলাপি ঋণ আদায় জোরদারে কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। ভুয়া জামানত দিয়ে ঋণ নেওয়া ঠেকাতে ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মূল্যায়ন করতে হবে।

ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ৬ কর্মপরিকল্পনা: খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ছয়টি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় পর্ষদে। এর মধ্যে রয়েছে- যোগ্য পরিচালক নির্বাচনের লক্ষ্য বর্তমান নীতিমালা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য হালনাগাদ করা; স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে আলাদা সম্মানি এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন; ব্যাংক এমডি বাছাই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে পরিপালন এবং পুনঃনিয়োগে কর্মমূল্যায়ন বিবেচনায় নেওয়া; খেলাপি ঋণ কমাতে এক গ্রাহকের ঋণসীমা যথাযথ মেনে চলা; কয়েকটি দূর্বল ব্যাংকে তুলনামূলক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভুত করা- এক্ষেত্র তিন বছর কারও চাকরি যাবে না এমন শর্ত থাকবে; এছাড়া ব্যাংকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ব্যাংকিং প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাশ বাধ্যতামূলক করা।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]