বাঘা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গণহত্যা দিবস পালিত


শাহানুর আলম বাবু,বাঘাঃ , আপডেট করা হয়েছে : 25-03-2022

বাঘা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গণহত্যা দিবস পালিত

রাজশাহীর বাঘায় ঐতিহাসিক ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালিত হয়েছে।  উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুক্রবার  (২৫ মার্চ) সকাল ১১ টায়  উপজেলা সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

নির্বাহী কর্মকর্তা  ( ইউএনও) পাপিয়া সুলতানার সভাপতিত্বে আয়োজিত সভায়  প্রধান বক্তা  হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রাজশাহী জেলা আ’লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. লায়েব উদ্দিন লাভলু।

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক  আশরাফুল ইসলাম বাবুল। 

অন‍্যান‍্যদের মাঝে বক্তব‍্য রাখেন উপজেলা প:প: কর্মকর্তা ডাঃ রাশেদ আহম্মেদ, বাঘা মহিলা কলেজের  অধ‍্যক্ষ নসিম উদ্দিন,  বীর মুক্তিযোদ্ধা তোরাপ আলী,  বাঘা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান ও বাঘা ইসলামি একাডেমি স্কুল অ‍্যান্ড. কলেজের দশম শ্রেনীর ছাত্রী জান্নাতুল নেসা জেমী ।

সভায় বক্তারা বলেন, আজ ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন একাত্তরের ২৫ মার্চ। 

এদিন রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। ২০১৭ সাল থেকে এ দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।

একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে ঢাকায় চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ায় বীর বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফোন করে জানাবেন।

সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায়, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।

এদিন সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক’।

ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের সঙ্গে।

এদিন বেলা ১১টার দিকে একটি হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন।

বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী।

এদিকে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী।

“এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

দাবানলের মত ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড।

রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়।

শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠছিল।

গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে।

ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে।

একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পতি হয় পুরো শহর।

সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।

রাত ১২.২০ সময়  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। এর পরই

রাত ১টায় পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি।

তিনি বলেছিলেন, “আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।”

বক্তারা আরও বলেন,বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার সম্পর্কে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ বদরুল আহসান রচিত 'ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার' বই টিতে উল্লেখ করা হয়,   “কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছাতেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান।”

এ সময় বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন 'ফায়ারিং বন্ধ কর।'

সাংবাদিক বি জেড খুসরু তার বই 'মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার'- এ লিখেছেন “গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

“শেখ মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।”

খুসরু আরও লিখেছেন, “কর্নেলকে শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন, আসার আগে আমাকে জানানো হল না কেন? কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে।”

জেড এ খান 'দা ওয়ে ইট ওয়াজ' বইতে লিখেছেন, "শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন 'বিগ বার্ড ইন কেইজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন'।”

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, “ওই রাতে মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষকে আমরা গ্রেপ্তার করে এনেছিলাম। পরে চাকরবাকরদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।”

গ্রেপ্তারের তিন দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে মেজর সালিক লিখেছেন, “পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেপ্তার করার সময়েই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন যে কোনও উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে।”

সমাপনি বক্তব্যে সবশেষে  নির্বাহী অফিসার বলেন, গণহত্যার ওই দিন একটি বিশেষ বিমানে করে বিদেশী সাংবাদিকদের দেশ ত‍্যাগে বাধ‍্য করা হয়। এছাড়াও পাক সেনাবাহিনী ওইদিন রাতে,   দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, গণবাংলা ও দৈনিক সংবাদ-এর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।

আলোচনা সভায় অন‍্যান‍্যের মধ‍্য উপস্থিত ছিলেন, নির্বাচন অফিসার মুজিবুল আলম,কৃষি কর্মকর্তা  শফিউল্লাহ সুলতান, আনসার ভিডিপি  অফিসার মিলন কুমার,  প্রধান শিক্ষক বাবুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, পরিমল কুমার, গনমাধ‍্যম ও মানবাধিকার সংগঠক শাহানুর আলম বাবু সহ বিভিন্ন  দপ্তর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও সূধীজন। 

উল্লেখ্য, সভায় কোরআন ও গীতা পাঠের মাধ‍্যমে  আলোচনা সভা শুরু করে সকল শহীদ আত্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সবশেষে রচনা লিখা ও চিত্রাঙ্কন সহ বিভিন্ন ক‍্যাটাগরিতে প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন কারিদের মাঝে পুরুস্কার বিতরন করা হয়।

রাজশাহীর সময় / এম জি


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]