আর্থিক সংকটে বন্ধের উপক্রম ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’


নিজস্ব প্রতিবেদক , আপডেট করা হয়েছে : 26-04-2022

আর্থিক সংকটে বন্ধের উপক্রম ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’

রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন মোঃ আবু জাফর। বাড়ি নগরীর ছোটবনগ্রাম প্রফেসরপাড়া। বাবা মহসীন-উল-বারী রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। আবু জাফর পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যসায়ী। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত। সুবিধাবঞ্চিত-অসহায় মা ও শিশুদের শিক্ষা দান, তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বাল্যবিয়ে ও মাদকাসক্ত বিষয়ে সচেতন করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম থেকে শিশুদের ফিরিয়ে এনে স্কুলমুখী করতে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ২০০৩ সাল থেকে তিনি এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যদিও এসব কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, কেউ কেউ তাকে পাগল বলেছেন। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। জাফরের অদম্য ইচ্ছা শক্তি এবং কঠোর পরিশ্রম দমিয়ে রাখতে পারেনি তার পথ চলাকে। তাই অর্থের অভাবে পড়ালেখা করতে না পারা সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায় শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন আবু জাফর। তিনি জমি লীজ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন।’ এই পাঠশালায় আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের আরবী ও ইসলামী শিক্ষাদান করা হয়। শুধু তাই নয়, নামাজ আদায়সহ নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বও দেওয়া হয়। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৫০ জন শিশু শিক্ষার্থীকে এসব শিক্ষাদান করা হয়। এসব শিশু শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি বই, খাতা, কলমসহ বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা উপকরণও বিতরণ করা হয়। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে মহতি এই কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ হওয়ার উপক্রম।    

আবু জাফরের প্রতিষ্ঠিত ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’ পাঠশালাটি রাজশাহী নগরীর ছোটবনগ্রাম পশ্চিমপাড়া কৈইটাপুকুর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। বার্ষিক ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে পাঁচ কাঠা জমিতে পাঠশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাঠশালার চারটি কক্ষ রয়েছে। তিন পালায় চলে পাঠশালাটি। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। এর বাইরে পাঠশালায় আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের আরবী ও ইসলামী শিক্ষাদান করা হয়। শুধু তাই নয়, নামাজ আদায়সহ নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বও দেওয়া হয়। শিশু ণ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৫০ জন শিশু শিক্ষার্থীকে এসব শিক্ষাদান করা হয়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশাপাশি তাদের মায়েরাও পড়ালেখা করেন এই পাঠশালায়। মায়েদের সংখ্যাও অন্তত অর্ধশতাধিক। পাঠশালায় শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম, পেনসিলসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়। পুষ্টিকর খাবার বিতরণ, শীত বস্ত্র, ঈদে পোশাক, খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। দরিদ্র পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। 

আবু জাফরের ছোট একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান রয়েছে। দুই ভাই মিলে চালান দোকানটি। দোকানের আয় থেকেই মূলত পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করেন তিনি। জাফর এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। স্ত্রী কানিজ ফাতেমা স্বামী জাফরের এ কাজে শুরুতে আপত্তি করলেও এখন তা মেনে নিয়েছেন। বরং এখন স্বামীকে সাধ্য মোতাবেক সহযোগিতা করেন। অর্থের অভাবে পড়ালেখা করতে না পারা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন জাফর। শিশুদের পড়ানোর নেশায় ও তাদেরকে সমাজের মূল স্রােত ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে ভালো চাকরির সুযোগ পেয়েও করেননি তিনি। 

আবু জাফর নয়া দিগন্তকে বলেন, পাঠশালায় সাতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। প্রতি মাসে তাদের কিছু বেতন দিতে হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করা এখন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবার কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ১৯ বছর ধরে নানা সীমাবদ্ধতা ও বাধা মোকাবেলা করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও বিনামূল্যে পাঠদান করে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে সরকার বা প্রশাসনের কোনো আর্থিক সহযোগিতা এ পর্যন্ত পাইনি। বর্তমানে আর্থিক সংকটে মহতি এ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাই এ অবস্থায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হলে পাঠশালাটিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব হবে। অন্যথায় এটির পাঠদান কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে আবু জাফর সমাজের ধনী, শিশুঅনুরাগী, পরোপকারী, মানবতাবাদী হিতাকাঙ্খী ও বিত্তবানদের আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। যাতে করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায়। আবু জাফর জানান, সম্প্রতি তিনি ‘স্মাইল মাউথ’ (ঝসরষব গড়ঁঃয) নামে একটি ফেসবুক পেজ চালু করেছেন।  

তিনি আরো বলেন, দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। আবার অনেক শিশু প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে আর্থিক কারণই মুখ্য। এছাড়া আরেকটি প্রধান কারণ হলো অভিভাবকদের অসচেতনতা, ফলে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলমুখী হতে চায় না। তারাও অল্প বয়সে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার জন্ম দিতে থাকে। 

আবু জাফর বলেন, মাঝে মাঝে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করি। ভাংড়ি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরোনো খাতা কেজি দরে কিনে ভেতরের অব্যাবহৃত সাদা পাতাগুলো দিয়ে খাতা বানিয়ে শিশুদের দিই। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের পাশে থাকি। করোনার মধ্যে জাফর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিবারকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করেন। যেসব এলাকায় দরিদ্র মানুষদের সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা নেই, তিনি সেসব এলাকায় সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করে দেন। 

পাঠশালাটির শিশু শিক্ষার্থীরা ও তাদের মায়েরা জানিয়েছেন, তারা চান এই পাঠশালাটি চালু থাকুক। যাতে করে তারা পড়ালেখা করে ভালো মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন। এজন্য সকলের সহযোগিতা চান তারা। এই পাঠশালায় পড়ালেখার মাধ্যমে তারা অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারছেন বলেও উল্লেখ করেন। 

রাজশাহীর সময়/ এম

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]