১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৩:১০:৪৩ অপরাহ্ন


দুনিয়াতেই দৃশ্যমান বেহেশতের বাগান
ধর্ম ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-১০-২০২২
দুনিয়াতেই দৃশ্যমান বেহেশতের বাগান ফাইল ফটো


সব প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার; যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর; যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাজিল হোক তার পরিবার পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর ।

জান্নাত চির শান্তির জায়গা। সেখানে আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি, আমোদ-প্রমোদ, চিত্ত বিনোদন ও আনন্দ- আহ্লাদের চরম ও পরম ব্যবস্থা রয়েছে। ভোগ-বিলাস ও পানাহারের আতিশয্যও রয়েছে সেখানে। জান্নাতিরা যা কামনা করবে কিংবা কোনো কিছু পাওয়ার আহ্বান জানাবে সব কিছু পাবে। প্রাচুর্যের কোনো অভাব হবেনা। এক কথায় পরম ও চরম শান্তি বলতে যা বুঝায় তা সবই জান্নাতে পাওয়া যাবে।

মহান রাব্বুল আলামিন জান্নাতের বাগান রেখেছেন পৃথিবীতেই। রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ : দুনিয়াতেই দৃশ্যমান বেহেশতের বাগান। এ দুনিয়ার একটি স্থানকে জান্নাতের বাগান ঘোষণা করেছেন বিশ্বনবী । বাস্তবেও সেখানে জান্নাতি পরিবেশ বিরাজ করে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাফনের মোবারক স্থানকে অনেকেই রওজা বা বাগান বলে সম্বোধন করে থাকেন । তবে তিনি একটি স্থানকে জান্নাতের বাগান বলে ঘোষণা করেছেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-আমার ঘর (বর্তমান দাফনের স্থান) এবং আমার মিম্বরের মাঝের জায়গা (রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ) জান্নাতের বাগানগুলোর একটি বাগান। আর আমার মিম্বর আমার হাওজের উপর অবস্থিত । (বুখারি)

মসজিদে নববিতে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারক এবং তাঁর জমানার মূল মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানকে নবীজি বেহেশতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলেছেন। মিম্বর ও হুজরাহর মধ্যবর্তী স্থান। এটাই রিয়াজুল জান্নাত। এর আয়তন দৈর্ঘে প্রায় ২২ মিটার আর প্রস্থে ১৫ মিটার। স্থানটি সীমানা দিয়ে ঘিরে রাখা। নির্ধারিত এ জায়গায় সবুজ-সাদা রঙের কার্পেট বিছানো আছে। মসজিদের অন্য কার্পেটগুলো লাল রঙের। ভিন্ন রঙের কার্পেট দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না রিয়াজুল জান্নাতের সীমানা। এ স্থানে নামাজ পড়া অতি উত্তম । হাদিসে পাকে এসেছে--

রিয়াজুল জান্নাত মসজিদে নববির মূল কেন্দ্র বিবেচনা করা হয় । জায়গাটি মসজিদে নববির সব থেকে মঙ্গলজনক জায়গা। তৎপর্য ও মাহাত্ম্যের বিবেচনায় রিয়াজুল জান্নাত হলো--দুনিয়ায় অবস্থিত জান্নাতের বাগানসমূহের একটি। তাই জিয়ারতকারীরা এখানে নামাজ আদায় ও দোয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন। তবে এখানে পাঠ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় এখানে দোয়া করতেন। তাই এখানে দোয়া করাটাই গুরুত্বপূর্ণ আমল। সেটা হতে পারে যেকোনো দোয়া।

রিয়াজুল জান্নাত এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা কখনো ফিরিয়ে দেন না। যে কারণে জায়গাটি সবসময় লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। মুসলিমরা সবসময় ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এখানে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন। এখানে একবার নামাজ আদায় বাইরে এক হাজার বার নামাজ আদায়ের সমতুল্য।  রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের জন্য নারী-পুরুষদের আলাদা আলাদা প্রবেশদ্বার রয়েছে। পুরুষদের জন্য স্থানটি সাধারণত তাহাজ্জুদের সময় খোলা হয় পরে আবার সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে যাওয়া যায়। আর নারীরা সেখানে ফজর, জোহর ও এশার নামাজের পর যেতে পারেন।

রিয়াজুল জান্নাত সম্পর্কে কয়েকটি ব্যাখ্যা

হজরত ইবনে হাজাম বলেন রিয়াজুল জান্নাতকে জান্নাতের বাগান বলা হয়েছে রূপকভাবে। ওলামায়ে কেরামরা রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে এখানে জিকির করলে রহমত ও সৌভাগ্য লাভ করা যায়।

হজরত নুরুদ্দিন সামহুদির লেখা ‘অফা আল অফা’র দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত রিয়াজুল জান্নাতে ইবাদত বেহেশতের বাগানে পৌঁছায় এই অর্থে ও তা রূপক অর্থবোধক। আল্লাহ এই স্থানটুকু হুবহু বেহেশতে স্থানান্তর করবেন। এই অংশ অন্যান্য জমিনের মতো নয় । পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো আমরা যেন ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ রাখি।

মসজিদে নববির ভেতরের রিয়াজুল জান্নাহ বা জান্নাতের বাগানের অংশে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে। সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বা খুঁটি বলা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তৈরি মসজিদে খেজুর গাছের খুঁটিগুলোর স্থলে উসমানী সুলতান আবদুল মাজিদ পাকা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্ণের কারুকাজ করা। প্রথম কাতারে ৪টি স্তম্ভের লাল পাথরের এবং পার্থক্য করার সুবিধার জন্য সেগুলোর গায়ে নাম লেখা রয়েছে । সেগুলো হলো-

উস্তুওয়ানা হান্নানা (সুবাস স্তম্ভ)

প্রথমদিকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বর ছাড়াই খেজুরগাছের একটি কাণ্ডে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন। পরবর্তী সময়ে জুমার খুতবা দেওয়ার জন্য দুটি সিঁড়ি ও একটি বসার স্থান তৈরি করা হয়। মিম্বরে নববির ডান পাশে খেজুরগাছের গুঁড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভ এটি। এতে নিয়মিত সুগন্ধি মাখানো হয় বলে একে সুবাস স্তম্ভ বলা হয়। এটি বর্তমানে স্তম্ভ আকারে আর নেই। একে উস্তুওয়ানা হান্নানাও বলা হয়।

উস্তুওয়ানা সারির

সারির অর্থ বিছানা। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তাঁর বিছানা এখানে স্থাপন করা হতো। এ স্তম্ভটি হুজরা শরিফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে। ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সেখানে তাঁর জন্য খেজুরপাতার তৈরি মাদুর এবং একটি বালিশ রাখা হতো। বুখারি শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যস্থতার জন্য এই স্তম্ভের কাছে বিছানা পেতে বসতেন ।

উস্তুওয়ানা উফুদ (প্রতিনিধি স্তম্ভ)

বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন প্রতিনিধিদল উস্তুওয়ানা উফুদে বসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কথা বলতেন। এ স্তম্ভও জালি মোবারকের সঙ্গে রয়েছে। তিনি আরবের বিভিন্ন প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানাতেন। তিনি তাঁদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন ও এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতেন। ফলে বহু গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। এটাকে গণ্যমান্য মজলিশও বলা হয়; যেখানে বড় বড় সাহাবায়ে কিরামও বসেছেন। একে প্রতিনিধি স্তম্ভও বলে ।

উস্তুওয়ানা আয়েশা (আয়েশা স্তম্ভ)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানতো তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতো । স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর ভাগ্নে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর।

উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ)

হজরত আবু লুবাবা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি ভুল সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকবো। আর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হজরত আবু লুবাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুর তওবা কবুল হলো। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন। এটিও উস্তুওয়ানা উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত।

পবিত্র নগরী মদিনার মসজিদে নববির বর্তমান মেহরাব তথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমাধিস্থল সংলগ্ন ডান পাশের স্থানটিই দুনিয়ার জান্নাতের বাগান। হজ, ওমরাহ ও জিয়ারতকারীরা এ স্থানে অবস্থান নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগি করে নিজেদের ধন্য করেন।

রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ আদায় হজ কিংবা ওমরাহ পালনের কোনো শর্ত নয়। অতএব প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে যদি আপনি সেখানে যেতে ব্যর্থ হন তাতে হজ কিংবা ওমরার জন্য কোনো অসুবিধা নেই। শুধু দোয়া করুন যেন আপনি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা । দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ এখানে তাড়াহুড়ো করে ধাক্কা ধাক্কি করে । এর ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয় ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে দুনিয়ার জান্নাতের বাগান (রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ) রিয়াজুল জান্নাত দেখার ও তাতে ইবাদত-বন্দেগি করার ও সকলকে প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তাওফিক দান করুন। সকলেই পড়ি-আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম।

ফখরুল ইসলাম নোমানী

লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।