২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩৪:০৫ অপরাহ্ন


ফুটবল কূটনীতি বাড়াচ্ছে বাণিজ্য সম্প্রীতি
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-১২-২০২২
ফুটবল কূটনীতি বাড়াচ্ছে বাণিজ্য সম্প্রীতি ফাইল ফটো


ফুটবল কূটনীতিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দুটি দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর আওতায় দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে। তবে বর্তমানে দুটি দেশের সঙ্গেই বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের অনেকে জানিয়েছেন, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও প্লাস্টিকসামগ্রীর রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ফলে দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও বাড়ানো এবং বিমান যোগাযোগ চালুর ওপর জোর দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের সমর্থকদের কারণে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে আমাদের একটা ভালো অবস্থান হয়েছে। এটা ভালো হয়েছে। আমরা এটাকে কাজে লাগাতে চাই।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ব্রাজিলে সীমিত আকারে পোশাক রপ্তানি করা হয়। আর্জেন্টিনায় রপ্তানি খুবই কম। দেশ দুটিতে পোশাক ও প্লাস্টিকসামগ্রী রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের নতুন বাজার হতে পারে দেশ দুটি।

বিভিন্ন সময়ে দুটি দেশেরই জার্সি তৈরির কাজ পেয়েছে বাংলাদেশ। শীতের পোশাক রপ্তানিসহ জিন্সজাতীয় পোশাক রপ্তানি বাড়ানো যেতে পারে। এজন্য দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি উদ্যোক্তা পর্যায়েও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে পর্যটন সুবিধাও বাড়ানো হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে। এজন্য ভিসা সংগ্রহ ও ভ্রমণ সহজ করাসহ বিমান যোগাযোগও চালু করা দরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দুটি দেশেরই মুদ্রার মান বেশ কম। সেজন্য ওই দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে খরচ কম হবে। এতে আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানির ঝুঁকিও কমবে। দুই দেশের সঙ্গে আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হলে টাকার সঙ্গে তাদের মুদ্রায় এলসি খোলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আসতে পারে।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ ডিসেম্বর শেষ হওয়া কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে ওই দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবল দলের অনেক সমর্থক রয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা কাপ ফুটবল খেলার সময়ও বাংলাদেশের বেশির ভাগ দর্শক এ দুটি দেশকে সমর্থন করে। দেশ দুটির খেলা বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে আনন্দ নিয়ে উপভোগ করেন।

দেশের ক্রিকেট খেলা নিয়ে যেমন আনন্দ-উল্লাস থাকে, তেমনই তাদের খেলা নিয়েও এসবের কোনো কমতি নেই। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় এ বিষয়টি বিস্তারিত জেনেছে ব্রাজিল সরকার। ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিল দূতাবাস থেকে তাদের ফুটবল দলের সমর্থনে বাংলাদেশের সমর্থকদের নজিরবিহীন উল্লাসের কিছু ভিডিওচিত্র পাঠানো হয়। এমন সব খবর শুনে ব্রাজিলের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন সাংবাদিক বাংলাদেশে এসে বেশকিছু সংবাদও প্রচার করেন। এরপর বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের অবিশ্বাস্য রকম উচ্ছ্বাসের খবর দেখে ব্রাজিলের সাধারণ জনগণও অভিভূত হয়।

এদিকে ফুটবল উন্মাদনার এমন সব খবরকে সামনে রেখে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় ঢাকা। তবে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশের আমদানি বাড়লেও রপ্তানি খুব বেশি বাড়েনি। সরকার এখন রপ্তানি বড়ানোর ওপর জোর দিতে চায়।

উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশটির অর্থনৈতিক কারণে একসময় বাংলাদেশে ব্রাজিল দূতাবাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশে ব্রাজিল ভক্তদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ফের ব্রাজিলের দূতাবাস চালু করা হয়। অবশ্য ব্রাজিলেও বাংলাদেশ দূতাবাস রয়েছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আর্জেন্টিনা টিম ছাড়াও মেসির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিপুল সমর্থনের কথা জেনে গেছে আর্জেন্টিনার জনগণও। এই সমর্থনের মাত্রা এতটায় বেশি ছিল যে আর্জেন্টিার ফুটবল দলের ফেসবুক পেজে বাংলাদেশে তাদের সমর্থনে উচ্ছ্বাসের ছবিও প্রকাশ করা হয়। এ অবস্থায় বিশ্বকাপ চলাকালেই বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলার পরিকল্পনার কথা জানায় আর্জেন্টিনা সরকার।

আর্জেন্টিনার জয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এক চিঠিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সেই চিঠির জবাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে এক বার্তায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট। এমনকি আগামী মার্চে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরের ঘোষণা দিয়েছেন। ওই সময়ে ঢাকায় তাদের দূতাবাস খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। বর্তমানে আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। ব্রাজিল দূতাবাস থেকে আর্জেন্টিনার কূটনৈতিক কাজ চালানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের আমদানির শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা রয়েছে। কিন্তু রপ্তানিতে নেই। আমদানিতে ব্রাজিল অষ্টম। আর্জেন্টিনা ১৯তম।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা থেকে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির ১ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ডলারের পণ্য। বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে ৭৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৬২ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ১ দশমিক ২ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৭ লাখ ৪১ হাজার ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ৬১ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশ প্রধানত ৫ ধরনের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বেশি আমদানি করা হয় অ্যানিমেল ও ভেজিটেবল ফ্যাট এবং ভোজ্যতেল। এ খাতে গত অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৪৭ কোটি ডলারের পণ্য। এছাড়া শস্যজাতীয় পণ্য গম ও বার্লি আমদানি হয়েছে ২০ কোটি ডলারের। প্রক্রিয়াজত খাদ্যসামগ্রী আমদানি হয়েছে ১২ কোটি ডলারের। এছাড়া তুলা ২৬ লাখ ডলারের এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি করা হয় ৫১ লাখ ডলারের।

বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় রপ্তানি পণ্যের বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। গত অর্থবছরে ৬১ লাখ ডলারই রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে এখন ৭০ শতাংশের ওপরে। চলতি বছরে ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)।

২০১০ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হয়েছিল। এরপর থেকে কমতে থাকে। ২০২০ সালে এর প্রবৃদ্ধি কমে ১০ শতাংশ নেতিবাচক হয়ে যায়। চলতি বছরে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশটি আইএমএফ-এর ৬০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে প্রবেশ করেছে। অচিরেই ওই ঋণের অর্থছাড় করবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে আইএমএফ। আর্জেন্টিনার মুদ্রার নাম পেসো। এক পেসো সমান বাংলাদেশের ৬২ পয়সা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্রাজিল থেকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২২৪ কোটি ৫১ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে, যা মোট আমদানির ৩ শতাংশ। রপ্তানি করা হয়েছে ১০ কোটি ১৭ লাখ ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ২১৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১৭৩ কোটি ৮২ লাখ ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১৬৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।

গত অর্থবছরে ব্রাজিল থেকে তেলবীজ, ভোজ্যতেল ও ফল আমদানি হয়েছে ৬০ কোটি ২৩ লাখ ডলারের, চিনি ৬০ কোটি ডলারের এবং তুলা ৪৬ কোটি ডলারের। এছাড়া অ্যানিমেল ও ভেজিটেবল ফ্যাট, আয়রন ও স্টিল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, গম, বার্লি, পুরোনো জাহাজ ও বোট তৈরির পণ্য আমদানি হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে তৈরি পোশাক। এর পাশাপাশি রাসায়নিক, ওষুধ, প্লাস্টিক, সিরামিক ও চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

ব্রাজিল ২০১০ সাল পর্যন্ত বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ছিল। এখন তা কাটিয়ে উঠেছে। ফলে তাদের মুদ্রার মানও বেড়েছে। দেশটির মুদ্রার নাম ব্রাজিলিয়ান রিয়েল। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর মান ২০ টাকা ৫০ পয়সা।

ব্রাজিলের জিডিপি ৪ থেকে ৩ শতাংশরে মধ্যে ওঠানামা করছে। চলতি বছরে জিডিপি ২ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।