২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১:৫৭:৪৬ অপরাহ্ন


ইবরাহিমের (আ.) নাম দরুদে থাকার কারণ
ইসলামীক ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০২-২০২২
ইবরাহিমের (আ.) নাম দরুদে থাকার কারণ ফাইল ফটো


‘দরুদে ইবরাহিম’ নামাজের শেষ বৈঠকে পড়া হয়। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের পাশাপাশি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতিও দরুদ পড়া হয়। এ দরুদে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাম উল্লেখ করার কারণ কী?

ইসলামিক স্কলাররা এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। তাহলো-

১. সমগ্র আবর জাহানের উর্ধ্বতন পিতা ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। বংশগতভাবে তারপর যত যত নবি-রাসুলের আগমন ঘটেছে; সবাই তাঁর বংশ থেকেই এসেছেন। তাই তাকে ‘আবুল আম্বিয়া বা নবিদের বাবা’ বলা হয়ে থাকে।

এ কারণেই তাঁর প্রতি দরুদ পড়ার কারণে তাঁর পরবর্তী সব নবি-রাসুলগণ তাতে শামিল হয়ে যান। কারণ তাঁর পরের সব নবি-রাসুলই বংশগতভাবে তাঁর পরিবারভুক্ত।

সুতরাং আসমানি কিতাবধারী সব ধর্ম তথা ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম; এ তিনটি মূল ধর্মের অনুসারীরাই তাঁর (ইবরাহিম আ.) শরিয়তের উপর বিশ্বাস রাখে। সে কারণেই ইসলাম এবং তাওরাত-ইনজিলের অনুসারী ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মকে এককথায় ইবরাহিমিয় ধর্ম' বা আবরাহামিয় ধর্ম (Abrahamic Religion) বলা হয়। এটিকে সেমেটিক ধর্ম বা সেমিটিক ধর্মও বলা হয়। যদিও ইয়াহুদি-খ্রিষ্টানরা পরবর্তীতে তাদের ধর্মে বিকৃতি করেছে।

২. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন উলুল আজম বা দৃঢ় সংকল্পধারী ৫ জন নবি-রাসুলের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّهُمۡ ؕ کَاَنَّهُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَ مَا یُوۡعَدُوۡنَ ۙ لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا سَاعَۃً مِّنۡ نَّهَارٍ ؕ بَلٰغٌ ۚ فَهَلۡ یُهۡلَکُ اِلَّا الۡقَوۡمُ الۡفٰسِقُوۡنَ

‘অতএব আপনি ধৈর্যধারণ করুন; যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী রাসুলগণ। আর তাদের জন্য তাড়াহুড়া করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল, যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, মনে হবে তারা পৃথিবীতে এক দিনের কিছু সময় অবস্থান করেছে। সুতরাং এটা এক ঘোষণা, তাই পাপাচারী কওমকেই ধ্বংস করা হবে।’ (সুরা আহকাফ : আয়াত ৩৫)

এ আয়াতে মক্কার কাফেরদের অশালীন আচরণের কারণে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেভাবে ধৈর্যধারণ করেছিলেন সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী নবি-রাসুলগণ। অর্থাৎ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামসহ যারা আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সম্মানিত এসব নবি-রাসুলগণের সংখ্যা হলো পাঁচ।

সব নবি-রাসুলই সম্মানিত। কিন্তু বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। যা তাকে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা তার অনেক মর্যাদা ও গুণাবলী উল্লেখ করেছেন।

৩. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাওহিদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক উৎখাতের এক মহান প্রাণপুরুষ ছিলেন। ইয়াহুদি-খ্রিষ্টানরা তাঁকে তাদের দলভূক্ত দাবি করলে মহান আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতিবাদে বলেন-

مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘ইবরাহিম ইয়াহুদি ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ও আত্মসমর্পণকারী এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৬৭)

৪. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে ‘তোমাদের কাওমের পিতা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সব নবি-রাসুলদের মধ্যে তাঁকে আদর্শ মেনে অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

مِلَّۃَ اَبِیۡکُمۡ اِبۡرٰهِیۡمَ ؕ هُوَ سَمّٰىکُمُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ

‘এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের দ্বীন। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’।’ (সুরা হজ : আয়াত ৭৮)

৫. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বংশগথতেভাবে আরবদের পিতা ছিলেন আর মর্যাদার দিক দিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত সব তাওহিদপন্থী মুমিনের পিতৃতুল্য।’ আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন-

> ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘এরপর আপনার প্রতি অহি পাঠিয়েছি যে, ইবরাহিমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’ (সুরা নহল : আয়াত ১২৩)

> إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَٰذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا ۗ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ

 ‘মানুষদের মধ্যে যারা ইবরাহিমের অনুসরণ করেছিল, তারা আর এই নবি এবং যারা এ নবির প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইবরাহিমের ঘনিষ্ঠতম। আর আল্লাহ হলেন মুমিনদের অভিভাবক।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৬৮)

৬. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন শেষ নবি হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁর ব্যাপারে বলেন-

وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۗ وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا

‘যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা অবনত করে; সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহিমের আদর্শের অনুসরণ করে; যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন, তার চাইতে উত্তম আদর্শ কার? আর আল্লাহ ইবরাহিমকে খলিল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) রূপে গ্রহণ করেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১২৫)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘সব নবি-রাসুলদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন- ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে এর পরেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম; এরপর হজরত মুসা আলাইহিস সালামের অবস্থান।’ (তাফসিরে ইবনে কাছির)

উল্লেখিত কারণে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন সম্মানিত ও মর্যাদাবান। যে কারণে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের পাশাপাশি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পরিবারবর্গের প্রতিও দরুদ পড়া হয়। আর ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাম থাকার কারণে মানুষ এ দরুদটিকে ’দরুদে ইবরাহিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এ নামেই দরুদটি পরিচিত হয়েছে।

বিশেষ কিছু কারণ

১. আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি হানাফি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্য একটি বিশেষ কারণ উল্লেখ করেছেন। তাহলো-

নামাজে দরুদ পাঠের সময় ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এর নাম এ জন্যই উল্লেখ করা হয় যে, মেরাজের রাতে যখন নবিজী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ করেন তখন পথিমধ্যে যত নবি-রাসুলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটেছিলো তাদের মধ্যে একমাত্র হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এই উম্মতের প্রতি সালাম পেশ করেছিলেন। তার প্রতিদান হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত মুমিন মুসলমানগণ তার প্রতি দরুদ পাঠে নির্দেশিত হয়।’ (আবু দাউদ লিল আইনি)

২. আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-

‘নবিদের মাঝে তাঁকে (ইবারাহিম আলাইহিস সালাম) বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, তিনি নবিদের পিতা, একনিষ্ঠ তাওজিদ অভিমূখী ও শিরক বিমুখ। আর আমরা তাঁকে অনুসরণের নির্দেশ প্রাপ্ত। কারণ আমরাই ইবারাহিম এর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ।’ (আল লিকাউশ শাহরি)

মূলত দরুদটির নাম ‘দরুদে ইবরাহিম’ নয়। বরং এ দরুদটিতে কোনো নবি-রাসুলের নাম আসা এবং তাঁর নাম উল্লেখ থাকার কারণেই মানুষ এটিকে দরুদে ইবরাহিম বলে আখ্যায়িত করেন। যেহেতু তাঁর প্রতি ও তাঁর পরিবারবের্গর প্রতি দরুদ পড়লে তার পরবর্তী সব নবি-রাসুলের প্রতি দরুদ পড়া হয়।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, নামাজের শেষ বৈঠকসহ অন্যান্য সময়ও এ দরুদটি বেশি বেশি পড়া। একনিষ্ঠ তাওহিদের অনুসরারি হওয়ার এবং শিরক থেকে বিরত থাকার আদর্শ অনুসরণে তাঁর ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি দরুদ পড়া।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বেশি বেশি দরুদ পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

রাজশাহীর সময় / এফ কে