২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০৫:৫৭:০৫ পূর্বাহ্ন


সিন্ডিকেটে চলছে রাবিতে সিট বাণিজ্য; ছাত্রলীগের হল সম্মেলনের পদ-প্রত্যাশীদের সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা
রাবি প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৩-২০২২
সিন্ডিকেটে চলছে রাবিতে সিট বাণিজ্য; ছাত্রলীগের হল সম্মেলনের পদ-প্রত্যাশীদের সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা ফাইল ফটো


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চলছে ছাত্রলীগের রমরমা সিট বাণিজ্য। করোনার দীর্ঘ বন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দেড় হাজারের কাছাকাছি সিট খালি হয়। শূন্য আসনে সিট বরাদ্দ দেয়ার কথা হল প্রশাসনের থাকলেও ছাত্রলীগই যেন সর্বেসর্বা! বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সিটের বিনিময়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ, হল প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে আবাসিকতা পাওয়া বৈধ শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয়া, সিট দখলে নিতে রুমে তালা লাগিয়ে দেয়া এধরনের বেশকিছু অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামলে শতাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে আসে। ক্যাম্পাসে ছেলেদের ১১ হলে সিট বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রমরমা সে বাণিজ্য সবার কাছে খোলামেলা হলেও মুখ খুলতে রাজি নন টাকা দিয়ে হলে ওঠা শিক্ষার্থীরা। এমনকি প্রকাশ হলে শারীরিক নির্যাতন ও নিজের সিট বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের। 

অনুসন্ধানে এসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. রাসেল ও একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর কথোপকথনের অডিও রেকর্ড হাতে পাওয়া যায়। কথোপকথনে টাকার জন্য নিজের আসল চেহারা দেখানোর হুমকিও দিতে শোনা যায় তাকে। যেখানে সিটের জন্য ৪ হাজার টাকা দেয়ার পর আরও টাকার জন্য দরকষাকষি করছিলেন তিনি। এই সংবাদ পাঠকদের জন্য কথোপকথনটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

রাসেল: টাকাটা কার কাছে দিছো?

শিক্ষার্থী : ৩ হাজার টাকা সারোয়ার ভাইয়ের কাছে, ১ হাজার টাকা আপনার কাছে। 

রাসেল: আমার কাছে সরাসরি দিছো?

শিক্ষার্থী : আপনাকে বিকাশ করে দিলাম।

রাসেলঃ তুমি সারোয়ারের কাছ থেকে হইছে যে  টাকা ফেরত লিয়ে লিও, ১০ টার মধ্যে যদি আজ টাকা না দাও তাইলে নেমে যেও। মানে তোমাকে যে বললাম আমি তুমি তো কিছুই মনে করছো না, কিছুই মনে হয়না নাকি? ঐভাবে কথা বইলতেছো? 

শিক্ষার্থী : ভাই আমি তো ভালোভাবে কথা বললাম।

রাসেলঃ আমার আসল রূপ দেখাতে হবে নাকি তোমাকে?

শিক্ষার্থী: আমি ভালোভাবে টাকা দিই নাই ভাই?

রাসেলঃ কাকে দিছ তুমি টাকা?

শিক্ষার্থী : আপনাকে দিছি। ৩ হাজার টাকা সারোয়ার ভাইকে দিছি ১ হাজার টাকা আপনাকে বিকাশ করে দিছি।

রাসেলঃ তুমি আমাকে টাকা দাওনি, তুমি সারোয়ারের কাছ থেকে টাকা লিয়ে লিও। নইলে অর মাধ্যমে তুমি হলে উঠো। আজকে যদি টাকা না দাও এটাই তোমার পরিণতি হবে, আমি ভালোভাবে বলে দিলাম। সেদিনকা ভালোভাবে বলে দিলাম, তুমি আমার কথা শুনোনি। সেদিনকা আমার প্রয়োজন ছিল, তুমি আমার পাশে দাঁড়াও নাই। 

শিক্ষার্থী : ভাই আপনি... তো বলছেন...

রাসেলঃ না না না... তুমি আমার পাশে দাঁড়াও নাই। তুমি নিজের মুখে বলছিলা ১৬ তারিখ। এইটা যদি হেরফের হয়, লড়চড় হয়, তাহলে আমি যেইটা কমিটমেন্ট করলাম অইডাই মনে রাখবা।

এ কথোপকথনের বিষয়ে নাম উঠে আসা ২ সহ-সভাপতির সাথে যোগাযোগ করা হলে সহ-সভাপতি মো. রাসেল বলেন, 'আপনি ওকে জিজ্ঞেস করেন সেকি আমাকে টাকা দিছে? না...? কিন্তু টাকা পাওয়ার পর নিশ্চিত হতে ফোন দেয়া অন্য একটি রেকর্ডে তাকে নিশ্চিত করতে শোনা যায়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'আপনি রেকর্ডে শুনলেও ওটা মিথ্যা। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন সে আমাকে টাকা দিছে কিনা? তবে আরেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার ৩ হাজার এবং তিনি ১ হাজার টাকা নিয়েছেন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'আমি যদি এক হাজার টাকা নিয়েও থাকি, সেটা সারোয়ার আমার বন্ধু এগুলো আলাদা বিষয়।'

কিন্তু ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী টুকিটাকি চত্ত্বর থেকে ১ হাজার টাকা ও পরে ৫০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রতিবেদককে।

ঘটনায় অভিযুক্ত আরেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ারকে এবিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'না না না। কে সে শিক্ষার্থী? নাম কি তার? কোন হলের এটা? এটা মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। রাসেলই বলতে পারবে ভালো। রাসেল বলেছে এ কথা? আমি ২০১৬ সালের পর থেকে সিটে উঠানো ছেড়ে দিছি।'

অনুসন্ধানে এ সিট বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন হলের বেশকিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ হাতে এসেছে, যারা ছাত্রলীগের আসন্ন হল সম্মেলনের পদপ্রার্থী। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে হলের সংখ্যা ১৭ টি। এরমধ্যে ছেলেদের হল ১১ টি আর মেয়েদের জন্য ৬ টি। করোনার বন্ধে হল ভেদে গড়ে ১০০-১৭০ আসন ফাঁকা হয়। এরমধ্যে সর্বনিম্ন ১০০ টি শেরে-বাংলা হলে আর সর্বোচ্চ ১৯৩ টি সিট সোহরাওয়ার্দী হলে ফাঁকা হয়। করোনা পরবর্তী সময়ে হলগুলোতে শত শত সিট ফাঁকা থাকলেও শুধুমাত্র শহীদ জিয়াউর রহমান হল ও শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছাড়া বাকি হলগুলোতে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এরমধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ১৯৬ (ক্যাম্পাস খোলার পর ফাঁকা আসন বেড়েছে) টি ফাঁকা আসনের বিপরীতে সিট বরাদ্দ দিয়েও ২৫-৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে হলে উঠাতে পারেনি প্রশাসন। এসব সিটগুলোতে আগে থেকেই অবৈধভাবে শিক্ষার্থী উঠিয়ে রেখেছে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এসব সিটে বৈধভাবে আবাসিকতা প্রাপ্তদের উঠাতে গেলে হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামতে দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। তবে ছেলেদের হলগুলো থেকেই বেশিরভাগ সময় হলের সিট বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও মেয়েদের হলগুলোতে এধরণের অভিযোগ উঠেনি। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির ছেলেদের ১১ টি আবাসিক হলে করোনাকালীন সময়ে শূন্য হওয়া ১৫০০ এর কাছাকাছি সিটের মধ্যে ১১ শতাধিক সিট লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী উঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সিটে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে উঠানো হয়েছে। তবে মোট কত টাকা বাণিজ্য হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। পদ-প্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে সিট বাণিজ্যের মাধ্যমে লেনদেনের অংক।

সিট বাণিজ্যের অংশ ফাঁকা সিটের ডাটাবেজ: 

কখন কোন সিট ফাঁকা হচ্ছে জানতে ছেলেদের ১১ টা আবাসিক হলে প্রতিটি ব্লকের রুমে রুমে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা। তথ্য সংগ্রহ করার এ কর্মসূচির নাম দেয়া হয় 'রুম ওয়ার্ক'। সেসময় হলগুলোতে শত শত সিট ফাঁকা থাকলেও বাকি যারা আছেন তাদের কার কবে মাস্টার্স শেষ হবে, কবে নাগাদ সিট ফাঁকা হবে, আবাসিকতা আছে কিনা সে সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে ছাত্রলীগ। বেশ কয়েকটি হলের ছাত্রলীগের হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের তৈরি করা ডাটাবেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। সে ডাটাবেজে শিক্ষার্থীর নাম, রুম নাম্বার, সেশন, ফোন নাম্বার লিপিবদ্ধ করা হয়। সে ডাটাবেজ ধরে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কোন সিটে কখন কে নামবে বা উঠবে। কখনও কখনও কে গেলে কে উঠবে, সেটিও বলে আসা হয়। 

সিটের মূল্যসীমা, কোন হলে কয় সিটের কতটাকা?

ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে শিক্ষার্থীদের হওয়া বেশকিছু কথোপকথনের অডিও রেকর্ড পাওয়া গেছে। এসব রেকর্ডের কথোপকথনের সূত্র ধরে জানা যাচ্ছে হলের অবস্থান ও রুমে সিট সংখ্যার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় সিটের দাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মধ্যে নবাব আব্দুল লতিফ, শাহ মখদুম, সৈয়দ আমির আলী এই ৩ হলের রুম গুলো মূলত ৩ জনের। আর বাকি ৮ টি হলে ৪ জন, ২ জন, ১ জন থাকার উপযোগী রুম তৈরি করা হয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বেশকিছু সূত্রে জানা গেছে, হল ও রুমের উপর ভিত্তি করে নির্ভর করে কত টাকায় বিক্রি হবে সিট। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সিঙ্গেল রুমের সিট  ৯-১১ হাজার টাকা, ৪ জনের সিট ৬-৮ হাজার টাকা। শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ২ জনের রুমে সিট ৬-৭ হাজার আর ৪ জনের সিটে সেটা ৪-৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। সৈয়দ আমির আলী, শাহ মখদুম ও নবাব আব্দুল লতিফ হলে সিঙ্গেল, ২ সিটের ও ৩ সিটের রুমে সিট প্রতি দিতে হয় ৪-৬ হাজার টাকা। আবার সৈয়দ আমীর আলী হলে বৈধভাবে আবাসিকতা প্রাপ্ত কোনো শিক্ষার্থী যদি এক রুম থেকে অন্য সিটে যেতে চায় তারজন্য গুনতে হয় ৫০০-১০০০ টাকা। জিয়া হলে সে অঙ্ক ১-২ হাজার টাকা। 

ওয়াশরুমের সীমানা ধরে ভাগাভাগি হয় সভাপতি গ্রুপ ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ। কোনো কোনো হলে সিঁড়িও সীমানা নির্ধারণে ব্যবহার হয়েছে। এই নিয়মে ওয়াশরুম বা সিঁড়ির প্রথম দিকের অংশের সিটগুলোর নিয়ন্ত্রণ সভাপতি গ্রুপের নেতারা করলে শেষ অংশের নিয়ন্ত্রণ সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের হাতে থাকে।

রুম-ওয়ার্কের মাধ্যমে তৈরি ডাটাবেজ ধরে শিক্ষার্থী উঠানো নামানো হয়। সিটে উঠানোর জন্য শিক্ষার্থী নিয়ে আসা ও টাকা আদায়ে জড়িত হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বেশ কয়েকজন কর্মী। সিট বিক্রির মূল্য অনুযায়ী ১০০০-১৫০০ টাকা পান সাধারণ কর্মীরা। আর বাদবাকি টাকা ভাগাভাগি হয় হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের মধ্যে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তত ২৪ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও সাধারণকর্মী জড়িয়েছেন সিট বাণিজ্যে। যাদের প্রত্যেকেই ছাত্রলীগের আসন্ন হল সম্মেলনের পদ-প্রত্যাশী। তাদের মধ্যে জিয়া হলের রাশেদ খান, হবিবুর রহমান হলের মিনহাজুল ইসলাম ও মমিনুল ইসলাম, মাদারবখশ হলের প্রিন্স হামীম শাফায়েত, আশিকুর রহমান অপু, জাহিদ হাসান সোহাগ, সোহরাওয়ার্দী হলের মাজহারুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন শাকিল, জোহা হলের মমিন ইসলাম ও চিরন্তন চন্দ, শেরে-বাংলা হলের স্বাধীন খান ও মোহাম্মদ রাতুল, বঙ্গবন্ধু হলে সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আহমেদ, কবিরুজ্জামান রাহুল, মেহেদী হাসান মিশু ও মঈনুদ্দিন রাহাত আহম্মেদ, মতিহার হলের রাজিব হোসেন ও ভাস্কর সাহা, নবাব আব্দুল লতিফ হলের আল শাহরিয়ার সজল, শুভ্রদেব ঘোষ, শাহ মখদুম হলের মুশফিক তাহমিদ তন্ময়, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আমির আলী হলের হাসান মো. তারেখ, শেখ সিয়াম ও আল আমিনের নাম উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে পাওয়া তালিকায়। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অডিও রেকর্ড, কল রেকর্ড, শিক্ষার্থীদের মৌখিক ও লিখিত বক্তব্যের স্পষ্ট ডকুমেন্টস প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেই টাকাগুলো হলের কর্মীদের হাতে থাকে না।

টাকাগুলো হাত বদলায়!

তাহলে সিট বাণিজ্যের টাকা কার পকেটে কীভাবে যায়? হলের সাধারণ কর্মী থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পকেট পর্যন্ত যায় সেটার গতিবিধির বর্ণনা করেছেন সভাপতি-সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন উপরের দিকের নেতা। তবে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তারা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বেশকিছু অডিও রেকর্ড থেকে কথোপকথন পর্যালোচনা করে বেশ কয়েকজন উপরের সারির নেতার নাম উঠে আসে।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সূত্রের ভাষ্য ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সূত্র ধরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিট বাণিজ্যের সাথে জড়িত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে। সেখানে দেখা যায়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হয়ে কেন্দ্র থেকে মোট ৪ জন সহ-সভাপতি নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো বাণিজ্য। তাদের মধ্যে সভাপতি অংশের দিক নিয়ন্ত্রণ করেন সহ-সভাপতি গোলাম সারওয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময় ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আহমেদ। তবে তাদের মধ্যে গোলাম সারওয়ারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলেও বাকি ২ জনের নাম উল্লেখ করেননি শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যাচ্ছে, তারাও কর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন হলে সিট বাণিজ্য করে থাকেন। আর সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর হয়ে কাজ করেন সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত, সহ-সভাপতি মো. রাসেল। এই ২ জনের নামে স্পষ্ট ডকুমেন্টস প্রমাণ পাওয়া গেছে শিক্ষার্থীদের সাথে কথোপকথনের অডিও ও ছাত্রলীগ নেতাদের ভাষ্যে। 

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের এক নেতা বলেন, 'সব কয়টা হলের সিট বাণিজ্যের মূল হোতা হচ্ছেন বৃত্ত দাদা। করোনার পরে যখন ক্যাম্পাস খুললো এরপর থেকে উনি একাই প্রায় ৬০ লাখ টাকার সিট বাণিজ্য করেছেন। উনার মাধ্যমে নেতারা কত টাকা পেয়েছে সেটা আমি জানি না। উনার পরিচয় হচ্ছে উনি ছাত্রলীগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারির বন্ধু। সেক্রেটারির বারে যাওয়া থেকে সবকিছু সাপ্লাই করেন উনি।'

এবিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের দিক থেকে হল সম্মেলনে পদ প্রত্যাশী এক নেতা বলেন, 'উনি বঙ্গবন্ধু হলে বসে এখানে (সোহরাওয়ার্দী হল) পর্যন্ত ছেলেপেলে উঠায়। বিভিন্ন হল থেকে রুনু ভাইকে বিচার দিলে উনি বলেন- আচ্ছা আমি দেখবো নে। রুমে বৃত্তকে ডেকে থ্রেট দিব নে। কিন্তু আল্টিমেটলি সব হচ্ছে। সেক্রেটারি আসলে তার সাথে লিয়াজো করে। হলে হলে বৃত্ত দাদার এজেন্ট আছে ।তাদের মাধ্যমে ছেলেপেলে উঠায় উনি। এ পর্যন্ত উনি একাই ৬০ লাখ টাকা মতো আয় করেছেন সিট বাণিজ্যের মাধ্যমে।' 

সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্তের সিট বাণিজ্যের প্রমাণ মেলে ফাঁস হওয়া এক অডিও রেকর্ডে। সে কথোপকথনের সূত্র ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। একটি হলের ডাবল সিটের কক্ষ নিয়ে সিট বাণিজ্যের কথোপকথনের রেকর্ড হাতে এসেছে। হলে সিট প্রত্যাশী এবং ছাত্রলীগ কর্মীর সেই কথোপকথনে স্পষ্ট হয়েছে পদহীন কর্মীদের দ্বারা সিট বাণিজ্য করেন বৃত্ত। ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের সেই কথোপকথনে হলে সিট প্রত্যাশী শিক্ষার্থী আরেক জনকে বলছেন, একটি ডাবল সিটের কক্ষের জন্য তিনি জয়ন্তকে (পদহীন ছাত্রলীগ কর্মী) সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিয়েছেন। এরপর অন্যজন বলছেন, ‘সাড়ে ৭ হাজার টাকা যাক, আরামে থাকতে পারবা। টাকাটা জয়ন্ত নিয়ে মনে হয় বৃত্ত দাদাকে (বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি) দিয়েছে। টাকা তো সাড়ে ৭ হাজার জয়ন্ত একা নিবে না। বড়জোর ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা জয়ন্ত রাখবে আর বাকিটা...।’ কথার মাঝে সিট প্রত্যাশী শিক্ষার্থী বলেন, ‘বৃত্ত দাদার কাছে সব সময় লিস্ট থাকে।’ 

সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্যানেলের সহ-সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকের দিক থেকে সিটের বিষয়গুলো উনি দেখেন কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমরা আরও আছি আরও অনেকেই দেখি। প্রত্যেকটা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দেয়া আছে।' সিটের তালিকার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এটা আমাদের হাতে কেন থাকবে? আমাদের ভাই-ব্রাদারের রুম নাম্বার আমরা জানি, বিভিন্ন কাজে যেতে হয় হলে।' 

তবে সিট বিক্রির মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা আয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু বিভিন্ন হলে প্রভোস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উঠান বলে স্বীকার করেছেন তিনি। 

২০১৪ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর উপর ছাত্র শিবির হামলা করলে ২য় তলার ছাঁদ থেকে একসাথে লাফ দিয়েছিলেন বৃত্ত আর রুনু। সে থেকে বন্ধুত্ব তাদের। বঙ্গবন্ধু হলে থাকলেও ১১ হল জুড়ে তার সিট বাণিজ্য, যেখানে হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ভাগের সিট গুলোতেও টাকা নিয়ে শিক্ষার্থী উঠিয়ে দেন তিনি। কিন্তু এ নিয়ে সাধারণ সম্পাদককে বিচার দিলেও চুপ থাকেন সাধারণ সম্পাদক, বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, 'এখনো পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি, এরকম কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। তবে মো. রাসেল সহ অন্যান্য নেতাকর্মীদের সিট বাণিজ্যে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তার বক্তব্য- এধরণের কোনো ঘটনা ঘটেছে তার জানা নেই, এবং কেউ তা করে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' 

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'সিট বাণিজ্যের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্সে অবস্থান নিয়েছি। এক্সাক্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব।' কিন্তু আগের গণমাধ্যমের সামনে আসা বেশকিছু ঘটনায় তারা সুনির্দিষ্ট কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তা জানতে চাইলে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি তিনি। তবে হল সম্মেলনে এ ধরনের অভিযোগগুলো মাথায় রেখে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা জানিয়েছেন তিনি। 

রাজশাহীর সময় / এএইচ