২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ০২:০১:৪৯ অপরাহ্ন


পার্বত্যাঞ্চলে দেশের উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১২-২০২৩
পার্বত্যাঞ্চলে দেশের উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি


পাহাড়ের কোলঘেঁষা সর্পিলাকার সড়ক। সূর্যের আলোতে কোথাও পাহাড়ের গভীর মিতালি, আবার কোথাও লুকোচুরি। যেন ছবির মতো জনপদ রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উদয়পুর। এটিই সীমান্তের শেষ ইউনিয়ন। ওপারে ভারতের মিজোরাম পাহাড়। উদয়পুর রাঙামাটির ভেতরে হলেও খাগড়াছড়ি হয়ে সেখানে পৌঁছানো সহজ। 

সীমান্ত সড়ক ঘেঁষেই উদয়পুর বাজার। ৮৩ পেরোনো স্নেহ কুমার চাকমার সঙ্গে সেখানেই কথা। জীবন সায়াহ্নে এসে সুখ-দুঃখের কথার ঝাঁপি খুললেন। বললেন, ‘গাড়ি দিয়ে এখন যাইতাছি-আসতাছি। অসুখ-বিসুখ হলে রোগীকে এখন খাগড়াছড়ি কিংবা চিটাগাং পর্যন্ত নেওয়া যায়। আগে পুরো এলাকা ছিল জঙ্গল।’ তিনি জানান, কিডনিসহ নানা রোগে দীর্ঘদিন ভুগে মাস ছয়েক আগে মারা গেছেন স্নেহকুমারের স্ত্রী কালাবি চাকমা। ওষুধের জন্য বাঘাইছড়ি পৌঁছতে এক সময় পথিমধ্যে দুই রাত পার হয়ে যেত। আর খাগড়াছড়ি পৌঁছার কথা খুব কম মানুষই কল্পনা করতেন। এখন সীমান্ত সড়ক নেটওয়ার্ক বদলে দিয়েছে পুরো এলাকার ছবি। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। ২০৩৬ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত প্রথম ধাপে ২০৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির বেতলিং, রাঙামাটির মাঝিরপাড়া ও সাইচলে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি। যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট। এর আগে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক ছিল বান্দরবানে পাহাড়ের ওপর দিয়ে নির্মিত থানচি-আলীকদম সড়কটি। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট ওপরে। ২০১৫ সালে নির্মিত হয়েছিল সড়কটি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে ২০, ২৬ ও ১৭ ইসিবি সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ফেনীসংলগ্ন খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে শুরু হয়ে বান্দরবানের আলীকদমের পোয়ামুহুরিতে গিয়ে শেষ হবে সড়কটি। পুরো রাস্তাটি সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। 

পার্বত্যঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, পুরোদমে এগিয়ে চলছে নির্মাণকাজ। ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়কটির বাংলাদেশের ভেতরে ৭০৩ কিলোমিটার। বাকিটা নির্মাণ হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ২০৫ কিলোমিটার রাস্তা। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ১১৭ কিলোমিটার, খাগড়াছড়িতে ১৫ কিলোমিটার ও বান্দরবান সীমান্তে ১৫ কিলোমিটার। দুই লেনের এই সড়ক ১৮ ফুট প্রশস্ত। দুর্গম পাহাড়কে মূল জনপদের সঙ্গে যুক্ত করছে দীর্ঘ এই রাস্তা। পাহাড়ের দুর্গম আর ‘দুর্গম’ থাকছে না। সীমান্তের এপার-ওপারকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বর্ডার আউট পোস্টে (বিওপি) দায়িত্বরত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত এই সড়ক ব্যবহার করে টহল জোরদার করতে পারবেন।   

সীমান্ত সড়কের প্রকল্প কর্মকর্তা (উদয়পুর) মেজর এইচ এম ইকরামুল হক বলেন, এ সড়কের নির্মাণের ফলে গহিন পাহাড়ের অরক্ষিত এলাকাও পুরোপুরি নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। বিস্তৃত এলাকার নিরাপত্তাসহ পর্যটন শিল্প বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। বেতলিং, মাঝিরপাড়া ও সাইচলে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কের রেকর্ড তৈরি হয়েছে।  

প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ এই সড়ক পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। এ ছাড়া পাশের দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সীমান্ত এলাকার কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখণ্ডে পরিবহনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মিজোরাম-ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে এটি।  

সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ের জনজীবনে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে– তা জানতে একাধিক পাহাড়ি বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। সাজেকের দাড়িপাড়ার সুখী চাকমা বলেন, রকমারি পণ্য নিয়ে এখন এক বাজার থেকে আরেক বাজারে দ্রুত যেতে পারছি। আমার স্বামী তোরন জীবন চাকমা গাড়িচালক। তারও আয়-রোজগার বেড়েছে। এক জায়গায় কাজ না পেয়ে অন্য জায়গায় যেতে পারছে। 

বাঘাইছড়ির একটি এনজিওতে কাজ করেন সুমন্ত চাকমা। তিনি বলেন, সীমান্ত সড়ক পাহাড়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। চিকিৎসাসেবাও অনেকের আরও দোরগোড়ায় কড়া নাড়বে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপন ও সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া ছাড়াও কৃষি এবং পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। সড়কটি শুরু হয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম থেকে। এর পর দোছড়ি-আলীকদম-থানচি-রেমাক্রি-ধুপানিছড়া সড়ক হয়ে তিন দেশের (বাংলাদেশ-মিয়ানমার-ভারত) সীমানা তিনমুখ পাহাড় ঘেঁষে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সীমান্তের রামগড় পর্যন্ত পৌঁছবে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া সড়কটির প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ সাতটি ভাগে বাস্তবায়ন হয়েছে। এর পর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। সীমান্তের গহিন ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ায় খুশি স্থানীয়রা। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকায় চোরাচালান ও মাদক নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর তিন পার্বত্য জেলায় অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন পার্বত্যাঞ্চলে পাকা রাস্তা নির্মাণ হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৭০০ কিলোমিটার, সড়ক সংস্কার ৬১৪ কিলোমিটার ও ব্রিজ নির্মাণ ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার ও কালভার্ট ১৪১টি।