২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০১:২০:৫৭ অপরাহ্ন


ডায়রিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৪-২০২২
ডায়রিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় ডায়রিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়


বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ডায়রিয়া রোগের ভয়াবহ রূপ নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডায়রিয়া সংক্রমণ দেশজুড়ে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। আইসিডিডিআর,বি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ)-এর তথ্যানুসারে, গত ৯ দিনে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ১৬১। কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির ৬০ বছরের ইতিহাসে রোগীর এমন চাপ নজিরবিহীন। এমনকি হাসপাতালের বাইরেও তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা চলছে। বিশুদ্ধ পানির যথেষ্ট জোগান না থাকায় এবং অতি ব্যস্ততার ফলে বাসি খাবারের ওপর নির্ভরশীলতা ডায়রিয়ার সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। এমন সংকটাপন্ন সময়ে সতর্ক থাকতে চলুন, ডায়রিয়া রোগের ব্যাপারে বিশদ জেনে নেওয়া যাক।

ডায়রিয়া সংক্রমণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা ভাইরাসগুলোর মধ্যে রয়েছে নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, এন্টারিক অ্যাডেনোভাইরাস, ভাইরাল হেপাটাইটিস ও সাইটোমেগালোভাইরাস। রোটাভাইরাস বাচ্চাদের ডায়রিয়ার তীব্রতার জন্য দায়ী। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসও ডায়রিয়া সংক্রান্ত জটিলতার সৃষ্টির পেছনে কাজ করে।

দূষিত পানি নরোভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস এবং স্যাপোভাইরাসের একটি বড় উৎস। হিমায়িত সবজি হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের বড় উৎস। নোরোভাইরাস থাকে পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি এবং তাজা ফলের মধ্যে। হেপাটাইটিস এ এবং নোরোভাইরাস সংক্রমণ অনুপযুক্ত খাদ্য পরিচালনার মাধ্যমেও হয়ে থাকে।

ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী

দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ই কোলাইয়ের মতো প্যাথজেনিক ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবীর সংস্পর্শে আসার ফলে ডায়রিয়া হয়। দূষিত পানি ছাড়াও ই কোলাই কাঁচা বা কম রান্না করা গরুর মাংস, কাঁচা শাকসবজি এবং পাস্তুরিত দুধে থাকে।

ওষুধ সেবন

কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলো দেহের খারাপ ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে। ফলে অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটে, যা পুরো শারীরিক অবস্থাকে ডায়রিয়ার দিকে ধাবিত করে। এ ছাড়াও অ্যান্টি-ক্যানসার ওষুধ এবং ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত অ্যান্টাসিড ডায়রিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী।

ল্যাকটোজ সমস্যা

ল্যাকটোজ হলো দুধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যে পাওয়া এক ধরনের চিনি। যাদের ল্যাকটোজ হজম করতে অসুবিধা হয়, তাদের দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার পর ডায়রিয়া হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাটি বাড়তে পারে। কারণ, যে এনজাইমটি ল্যাকটোজ হজম করতে সাহায্য করে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাত্রা কমতে থাকে।

ডায়রিয়ার লক্ষণ

ডায়রিয়ার প্রধান উপসর্গগুলো হলো মলত্যাগের জন্য প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হওয়া এবং ঘনঘন পাতলা পায়খানা। এ ছাড়াও বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, পেটে চাপ অনুভূত হওয়া, পেট ফোলা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত অবস্থায় ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হয়।

ডায়রিয়ার গুরুতর জটিলতা হলো পানিশূন্যতা। ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তরলের একটি বিশাল অংশ বেরিয়ে যায়। আর এর ফলেই পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ে। পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো হলো প্রচণ্ড ক্লান্তি, শুকনো শ্লেষ্মা, হৃদ্‌স্পন্দন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, প্রস্রাব হ্রাস ও শুষ্ক মুখ।

বাচ্চারা ডায়রিয়া এবং পানিশূন্যতার ক্ষেত্রে বেশ সংবেদনশীল। এ সময় বাচ্চাদের প্রস্রাব কমে যায়, মুখ শুকিয়ে যায়, মাথাব্যথা হয়, ক্লান্ত দেখায়, কান্নার সময় চোখে পানি থাকে না, চোখ আধবোজা-আধখোলা অবস্থায় থাকে, তন্দ্রাতুর দেখায় এবং সবসময় বিরক্ত থাকে।

ডায়রিয়া হলে করণীয়

সাধারণ অবস্থায় ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। শরীর খারাপের সময়টুকু বিশ্রামের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানীয় পান করতে হয় এবং অন্যান্য খাবারের সময় সতর্ক থাকতে হয়।

শরীরকে পানিপূর্ণ রাখার জন্য পরিষ্কার তরল পানি ও ফলের রস খেতে হবে। এ সময় দিনে প্রায় ২-৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। একবারে টান দিয়ে পুরো গলাধঃকরণের পরিবর্তে অল্প পরিমাণে চুমুক দিয়ে পান করা যেতে পারে।

ডায়রিয়া হলে দেহকে পানিপূর্ণ রাখতে ডাক্তার লবণ, পটাসিয়াম এবং ক্লোরাইডের মতো স্পোর্টস পানীয়গুলো পানের পরামর্শ দিতে পারেন। ঘনঘন বমি বমি ভাব হলে ধীরে ধীরে তরলে চুমুক দিয়ে পান করা ভালো। এ সময়ের জন্য উপযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে আলু, চীনাবাদামের মাখন, টার্কির মাংস ও দই।

যে খাবারগুলো ডায়রিয়া বা শরীরে গ্যাসের অবস্থা আরও খারাপ করে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলোর মধ্যে আছে চর্বিযুক্ত বা ভাজা খাবার, কাঁচা ফল এবং শাকসবজি, মসলাদার খাবার, মটরশুঁটি ও বাঁধাকপি এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন: কফি ও সোডা।

যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই শরীর উন্নতির দিকে যায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। যদি উপসর্গ ২ দিনের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি অবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এগুলো হলো অবিরাম বমি, ক্রমাগত ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, উল্লেখযোগ্য হারে ওজন হ্রাস, মলের মধ্যে পুঁজ ও রক্ত, কালো মল বের হওয়া ইত্যাদি।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যে উপসর্গগুলো অবিলম্বে চিকিৎসার দাবি রাখে সেগুলো হলো ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া, জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি, রক্ত ও পুঁজ মল এবং কালো মল।

ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ডায়রিয়া হলে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কথা বলতে পারেন। অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে ডাক্তার রোগীর কিছু শারীরিক অবস্থা নিরীক্ষা করবেন। সেগুলো হলো ডায়রিয়া তীব্রতা, পানিশূন্যতার তীব্রতা, রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অবস্থা, চিকিৎসা ইতিহাস, বয়স, এবং রোগীর বিভিন্ন পদ্ধতি বা ওষুধ সহ্য করার ক্ষমতা।

যেকোনো ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার মোক্ষম উপায় হলো খাবার তৈরি ও খাওয়া আগে এবং পরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেওয়া। রান্না করা, টয়লেট ব্যবহার, বাচ্চার ডায়াপার পরিবর্তন, হাঁচি, কাশি এবং নাক ফুঁকানোর পর হাত ধুয়ে নেওয়া জরুরি। হাতে সাবান লাগানোর পর কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য দুই হাত একসঙ্গে ঘষতে হবে। হাত ধোয়ার বিকল্প হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা উচিত। এ সময় হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যেন তা উভয় হাতের সামনে এবং পিঠে ভালোভাবে লাগে। একটি ভালো হ্যান্ড স্যানিটাইজারে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে।

ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা

ডায়রিয়া বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের সময় সংক্রমণ হতে পারে। যেখানে ভ্রমণ করা হচ্ছে সেখানকার অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং দূষিত খাবার নিমেষেই শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে করণীয়গুলো হলো:

নতুন জায়গায় খাবারের ব্যাপারে সতর্কতা

গরম ও ভালোভাবে রান্না করা খাবার খান। কাঁচা ফল এবং শাকসবজি এড়িয়ে চলতে হবে। অবশ্য সেগুলো রান্নার জন্য প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ নিজেই করলে খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও কাঁচা বা কম রান্না করা মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি।

নতুন জায়গার পানীয়র ব্যাপারে সতর্কতা

বোতলজাত পানি বা সোডা বোতল থেকেই পান করা উচিত। কলের পানি এবং বরফের টুকরো এড়িয়ে চলতে হবে। এমনকি দাঁত ব্রাশ করার জন্যও বোতলজাত পানি ব্যবহার করা জরুরি। গোসল করার সময় বোতলের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। সিদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি কফি এবং চা নিরাপদ। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন ডায়রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে, যা পানিশূন্যতাকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেয়।

ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ

দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণের জন্য আগে থেকেই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া যেতে পারে। এ সময় ডাক্তার শরীরের যাবতীয় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যাচাই করে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেবেন।

পরিশিষ্ট

কোভিডের চাপটা কমতে না কমতেই শুরু হয়ে গেছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। মূলত এ রকম  সংক্রমণ আকস্মিক নয়। বরং সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থার অস্থিতিশীলতা এ ধরনের রোগবালাইয়ের কারণকে সুসংহত করে। জীবন ও জীবিকা সামলানোর অনিয়ন্ত্রিত দৌড়ে আশপাশের পরিবেশ ও শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর এর সঙ্গে যখন উদাসীনতা যোগ হয়, তখনই চাপের ভয়াবহতা বাড়তে থাকে।

রাজশাহীর সময় / এম আর