২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১২:৫২:৫৫ পূর্বাহ্ন


‘ফজলি আম’ নিয়ে রাজশাহী-চাঁপাই লড়াই, জিআই নিয়ে আপত্তির শুনানি আগামীকাল
নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৫-২০২২
‘ফজলি আম’ নিয়ে রাজশাহী-চাঁপাই লড়াই, জিআই নিয়ে আপত্তির শুনানি আগামীকাল ফাইল ফটো


বহুকাল আগে রাজশাহীর বাঘা থেকে প্রচুর আম যেত কলকাতা। এই আমের ছবিই পোড়ামাটির টেরাকোটায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৫২৩ সালে নির্মিত বাঘা শাহী মসজিদে। এই আমটিই এখন পরিচিত ‘ফজলি আম’ হিসেবে। গত বছর এই আমকে রাজশাহীর ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর। 

কিন্তু এতে আপত্তি জানিয়েছে পাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। রাজশাহীকে এই আমের স্বত্ব দেওয়ার নারাজি দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশন দাবি করে, এই আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের। তবে গবেষকেরা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। তার আগে ওই এলাকা ছিল বৃহত্তর রাজশাহীরই অন্তর্গত। তাই অতি পুরোনো ‘ফজলি আম’ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাদা স্বত্ব দাবি করা একেবারেই হাস্যকর। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি ও রাজশাহীর ফজলি আমের মধ্যে আছে পার্থক্যও। 

জানা গেছে, ২০১৭ সালের শুরু দিকে বাঘার ‘ফজলি আম’ রাজশাহীর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তিতে জিআই সনদ আটকে যায় রাজশাহীর ফজলি আমের। মঙ্গলবার (২৪ মে) শুনানির মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর। সেদিনই সিদ্ধান্ত হবে ফজলি কোথাকার। 

বাঘার ফজলি আমের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় ১৯১২ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত করা সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অপারেশনস ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহীর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে স্পষ্টভাবে ‘দি বাঘা ম্যাঙ্গো’ বা বাঘার আম, যা কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর ‘আম’ বইটির অষ্টম অধ্যায়ে আমের জাত বিভাগে ৯৭ পৃষ্ঠার তথ্য অনুযায়ী বাঘার ফজলির পরিচিতি অন্তত ২০০ বছরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত ঐতিহাসিক বাঘা শাহী মসজিদের টেরাকোটার কারুকাজেও দেখা মেলে এই আমের ছবি। গবেষকেরা বলছেন, কারুকাজ করা এই আম ফজলি আমের প্রতিচ্ছবি। জনপ্রিয়তার কারণেই আমটি মসজিদে স্থান পায়। 

গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলছেন, বাঘার মসজিদে যে আমের প্রতিচ্ছবি, তা ১০০ ভাগ ফজলি আমের। বাঘার ফজলি আমের ইতিহাস অতি প্রাচীন। একসময় এই আম প্রচুর পরিমাণে ‘নাটোর ম্যাঙ্গো’ নামে কলকাতায় যেত। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে ফজলি আছে, এটা তার চেয়ে আলাদা। চাঁপাইয়ের ফজলি আকারে বড়, স্বাদে কম। বাঘার ফজলি আকারে ছোট, কিন্তু স্বাদ বেশি। ইতিহাস না জেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্বত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব করছে বলে মনে করেন এই গবেষক। 

মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এটা সত্য যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রচুর ফজলি আমের গাছ আছে। কিন্তু ওই আম আর রাজশাহীর বাঘার আম আলাদা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলিকে এখনো ‘‘মালদার ফজলি’’ হিসেবে এখনো ডাকা হয়। ভারতের মালদার ফজলি আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি একই। ওই আমের স্বাদ, আকার সবই রাজশাহীর থেকে আলাদা।’ 

ফজলির জিআই নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে আপত্তি দেওয়া হলেও এর সঙ্গে আছেন ইসমাইল খান শামীম। তিনি শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামের একটি সংগঠন চালান। শামীম বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩০ শতাংশ আমবাগান ফজলির। এখানে ২০০ বছরের পুরোনো বাগানও আছে। তাই তাদের দাবি, ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই। 

তবে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হাসান ওয়ালিউল্লাহ বলেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমের যে জাতের কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাঘার ফজলির স্বাদ, আকার, ওজনসহ অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওই আমটি আসলে ভারতের মালদার। আর ওই ফজলি ‘মালদার ফজলি’ হিসেবে আগেই জিআই পেয়েছে। এর ফলে তখনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের স্বত্ব শেষ হয়ে গেছে। 

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, ‘শুনানিতে জিততে দালিলিক প্রমাণপত্রের পাশাপাশি বাঘা ফজলির ভৌগোলিক পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয়েছে। রাজশাহীর ফজলি যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বা ভারতের মালদার ফজলির চেয়ে আলাদা, সেটি আমরা প্রমাণ করতে পারব। তাই আশা করছি, বাঘার ফজলিই ‘রাজশাহীর ফজলি আম’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাবে।’

রাজশাহীর সময়/এইচ