২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০৪:০৮:০৩ পূর্বাহ্ন


সংবাদ সম্মেলনে চরম বাক-বিতন্ডা নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকায় পথমেলার নামে প্রতারণা, প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ
নোমান ইবনে সাবিত/বিপি, নিউ ইয়র্ক:
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৬-২০২২
সংবাদ সম্মেলনে চরম বাক-বিতন্ডা নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকায় পথমেলার নামে প্রতারণা, প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ চরম বাক-বিতন্ডা নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকায় পথমেলার নামে প্রতারণা, প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ


গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এখন চলছে স্ট্রিট ফেয়ার বা পথামেলা। এসব পথমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতারক চক্ররা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ওঠার সাথে সাথেই নিউ ইয়র্কসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চলছে রমরমা পথামেলা বানিজ্য। পথমেলা থেকে আয়ের অর্থ দেশে অসহায় পথশিশুদের জন্য ব্যয় করা হবে। এ ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ কামিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে ওই প্রতারক চক্রটি। এ নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে বাড়ছে চরম ক্ষোভ ও তিক্ততা। এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বাংলা প্রেস।

গত ২৯ মে রোববার নিউ ইয়র্কের 'জ্যামাইকা বাংলাদেশ পথমেলা' নামকরণে পথমেলার আয়োজন করেন জ্যামাইকা বাংলাদেশি আমেরিকান ফাউন্ডেশন নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংগঠন। বাংলাদেশের অসহায় পথশিশুদের সাহায্যার্থে জ্যামাইকা হিলসে অনুষ্ঠিত মেলা ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের ঝড় বইছে জ্যামাইকাসহ গোটা নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে। ফেইসবুক সহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া সরব হয়ে উঠেছে। জ্যামাইকা বাংলাদেশ মেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজক সংগঠন ব্যাপক অনিয়ম ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী প্রবাসীরা।

জানা যায় উক্ত মেলায় কনকচাঁপা, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ যে সকল শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করবেন বলে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় পত্রিকায় কার্যত তাদের কেউ সঙ্গীত পরিবেশন করেননি। আর স্থানীয় যে সকল শিল্পী গান গেয়েছেন তাদেরকে নূন্যতম কোন সম্মানী দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিল্পী। মেলায় অর্জিত সমুদয় অর্থ বাংলাদেশের পথ শিশুদের জন্য পাঠানো হবে এমন অজুহাতে শিল্পীদেরকে বিমুখ করা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ঘটেছে র‌্যাফেল ড্র নিয়ে। মেলায় র‌্যাফল ড্র’তে ‘নতুন একটি গাড়ি’ থাকবে প্রথম পুরস্কার হিসেবে সাংবাদিক সম্মেলনে এমন ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু মেলার দিন গাড়ির কোন অস্তিত্ব ছিলো না। মেলায় ৫ ডলার মূল্যে স্বাভাবিক র‌্যাফল ড্র’র টিকিট বিক্রি করা হলেও শেষ পর্যন্ত কোন র‌্যাফল ড্র অনুষ্ঠিত হয়নি। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে এমন ঘোষণা থাকলেও ৭টার মধ্যে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় পুলিশের নির্দেশে। ফলে পুরষ্কার ছাড়াই বাড়ি ফিরতে হয়েছে র‌্যাফেল টিকিট ক্রয়কারীদের।

এছাড়াও মেলায় যেসকল ভিআইপি অতিথি থাকবেন বলে ফোনে জানিয়েছিলেন আয়োজক, তাদের কারো দেখা মেলেনি মেলায়। কাঙ্খিত দর্শক শ্রোতার অভাবে স্টলগুলো ব্যবসায়িকভাবে মার খেয়েছে এমন অভিযোগ অনেকের। জ্যামাইকা বাংলাদেশি আমেরিকান ফাউন্ডেশন সম্পূর্ন নূতন একটি সংগঠন। ২৯ মে’র মেলাকে উপলক্ষ্য করে রাতারাতি সংগঠনটির গোড়াপত্তন ঘটান কমিউনিটির পরিচিত মুখ নাসির আলী খান পল। এজন্য তিনি বাংলাদেশের ‘পথশিশুদের সাহায্যার্থে’ শ্লোগানটি সামনে নিয়ে আসেন।

গত ৭ মে জ্যামাইকার স্টার কাবাব রেস্তোঁরায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মেলার বিভিন্ন দিকের কার্যক্রম ঘোষণা দেন নাসির আলী খান পল। জ্যামাইকা পথমেলার বাজেট ৫০ হাজার ডলার বলে জানান তিনি। মেলায় ১০/১২ হাজার মানুষ অংশ নিবেন। পৃষ্ঠপোষক ছাড়াও মেলায় অংশ গ্রহণকারীদের নিকট থেকে ১ ডলার করে অনুদান নেয়া হবে পথশিশুদের জন্য। সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক সংগঠন এবং এর কর্মকর্তাদের পরিচিতি সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি পল খান। আসলে মেলাকে সামনে রেখে নিবন্ধিত সংগঠনটি একান্তভাবেই তার নিজস্ব। ব্যাংক একাউন্টিও তার হাওলায়। তিনি ছাড়া এ সংগঠনের দ্বিতীয় কোন কর্মকর্তার নাম সংবাদ সম্মেলনে বলতে পারেননি পল খান।

মেলার বিজ্ঞাপনে কমিউনিটির বিশেষ করে জ্যামাইকার পরিচিত অনেকের নাম সেঁটে দিলেও তাদের সিংহভাগ মানুষ এব্যাপারে কিছু জানতেন না। ফলে অনেকেই তাদের নাম বিজ্ঞাপন থেকে প্রত্যাহার করতে বলেন। এসব নিয়ে বিপাকে পড়েন আয়োজক। অনেকের সাথে গরম বাক্য বিনিময় হয়। এজন্য প্রতিদিনই কর্মকর্তাদের নামের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় বিজ্ঞাপনে। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় শোভা পাচ্ছে এমন অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিজ্ঞাপনে তাদের নাম দেখে। তারপরও পথকলিদের কথা শুনে অনেকে মোটা অংকের অনুদান দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মেলাতে আশানুরূপ জনসমাগম না হওয়ায়  পৃষ্ঠপোষকগণও হতাশ এবং অখুশী। সবকিছু মিলিয়ে জ্যামাইকা বাংলাদেশ পথমেলা নিয়ে আগে থেকেই বিভ্রান্তি ও ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। যার চূড়ান্ত বর্হিপ্রকাশ ঘটে মেলার দিন অনিয়মের মধ্য দিয়ে।

যারা আয়োজকের ঐকান্তিক অনুরোধে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন তারাও এখন ক্ষুব্ধ। জ্যামাইকায় বাংলাদেশের পথশিশুদের নামে ব্যক্তিবিশেষ মেলা আয়োজন করে পার পেয়ে যাবে এমনটি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। অচিরেই এ বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হবে বলেও জানান স্থানীয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে পল খান একক সিদ্ধান্তে সবকিছুই করেছেন। পুরো হিসেব-নিকেষ তার কাছে। পথশিশুদের সাহায্যের আড়ালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কাজ করেছে বলে তাদের ধারণা। ফলে পথশিশুদের জন্য আয়োজিত পথমেলা পথ হারিয়ে এখন বিপাকে। জ্যামাইকাবাসী চান পথকলিদের নামে সংগৃহীত অর্থের হিসাব ও স্বচ্ছতা।

এদিকে গত শনিবার (৪ জনু) মেলা পরবর্তী একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন 'জ্যামাইকা বাংলাদেশি আমেরিকান ফাউন্ডেশন' নামের সেই ভুঁইফোড় সংগঠনটি। জ্যামাইকার স্টার কাবাব রেস্তোঁরায় অনুষ্ঠিত উক্ত সংবাদ সম্মেলনে 'জ্যামাইকা বাংলাদেশ আমেরিকান ফাউন্ডেশন'-এর শুধুমাত্র সস্ত্রীক নাসির খান পল ছাড়া আর কোন সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। এ নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের মাঝে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত সাংবাদিকদের বেশ কয়েকজন জানান তার (নাসির খান পল) সংবাদ সম্মেলনে কারই যাওয়ার ইচ্ছে ছিলে না শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল আনার জন্য সম্পাদক/সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে 'জ্যামাইকা বাংলাদেশ পথমেলা'র আয়োজক নাসির খান পল তার নতুন সংগঠনের কমিটি এবং পথমেলার লাভ-ক্ষতির হিসেব দেন। নানা ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে মেলায় আর্থিক ক্ষতির কথা তুলে ধরেন তিনি। অসহায় পথশিশুদের সাথে প্রতারণা, মেলায় র‌্যাফল ড্র’তে ‘নতুন একটি গাড়ি’ প্রথম পুরস্কার ঘোষনা দিয়ে প্রবাসীদের সাথে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রতারণা এবং পৃষ্ঠপোষকদের কাছে থেকে ডোনেশনের নামে ব্যাপক হারে অর্থ আদায় সংক্রান্ত  সাংবাদিকদের ছুঁড়ে দেওয়া অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন নাসির খান পল। মেলার নামে ৪০ হাজার ডলারেরো বেশি অর্থ আদায়ের অভিযোগ থাকলেও তিনি মাত্র ৬ হাজার ডলার আদায়ের কথা স্বীকার করেছেন। মঞ্চ সাজ-সজ্জাকারীদেরকে দেওয়া ৬ হাজার ডলারের দেওয়া একটি চেক সমপরিমাণ অর্থ জমা না থাকায় ব্যাংক থেকে ফেরত পাঠনো হয়েছে বলে জানা গেছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নাসির খান পল বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোশিয়েশন, নর্থ বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, তার জেলার আঞ্চলিক সংগঠন ভাঙা ও বিভক্তির পেছেনে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে আগন্তুক হিসেবে প্রবেশকারী জ্যামাইকার ব্যবসায়ী ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট ফকরুল ইসলাম দেলোয়ার কোন সাংবাদিক না হয়েও সুকৌশলে সংবাদ সম্মেলনে প্রবেশ করেন এবং উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলে সম্মেলনের আয়োজক নাসির খান পল প্রথমেই বাধা দেন। এসময় উভয়ের মধ্যে চরম বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরে সাংবাদিকদের অনুরোধে তাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়।  

দেলোয়ার সরাসরি অভিযোগ করেন, জ্যামাইকা বাংলাদেশ আমেরিকান ফাউন্ডেশন নামে 'জ্যামাইকা বাংলাদেশ পথমেলা'-এর আয়োজন করেন মূলতঃ নাসির খান পল একাই। এখানে জামাইকাবাসী বাংলাদেশিদের কোন সম্পৃক্ততাই ছিল না। অথচ তিনি বিপুল সংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ব্যাপহ হারে চাঁদাবাজি করেছেন বলে জামাইকাবাসীদের হাতে তার প্রমাণো রয়েছে বলে উল্লেখ করেন দেলোয়ার।  

ফকরুল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মেলার দিন নির্ধারনের পর থেকে মেলার দিন পর্যন্ত পৃষ্ঠপোষক ম্যাগাজিনের জন্য বিজ্ঞাপন ও মেলায় জন্য দান বা ডোনেশনের অর্থ প্রায় ৪০ হাজার ডলারেরও বেশি অর্থ তিনি আদায় করেছেন অথচ উক্ত সংবাদ সম্মেলনে মাত্র ৬ হাজার ডলার আদায়ের কথা স্বীকার করেন তিনি যা প্রবাসী এবং বাংলাদেশের অসহায় পথশিশুদের সঙ্গে মহাপ্রতারণা। এসব কর্মকান্ডের জন্য জামাইকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে শিগগির নাসির খান পলকে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন দেলোয়ার।