১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৮:৪১ অপরাহ্ন


২২ বছরের তরুণীর রহস্যমৃত্যু, রণক্ষেত্র ইরান!
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৯-২০২২
২২ বছরের তরুণীর রহস্যমৃত্যু, রণক্ষেত্র ইরান! ফাইল ফটো


সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে ইরানের রাজধানী তেহরান-সহ কমপক্ষে ৮০টি শহর। মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন সে দেশের বহু মানুষ। কিন্তু কেন মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ইরান? নেপথ্যে ইরানের ২২ বছরের এক তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যু।

পশ্চিম ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের সাক্কেজ শহরের বাসিন্দা ছিলেন মাহশা। ১৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানে আসছিলেন তিনি। তেহরানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মাহশা দেখা করতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ভাই কিয়ারেশ আমিনিও।

কিয়ারেশ এবং মাহশা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় তেহরানের কিছু আগে তাঁদের পথ আটকায় টহলে থাকা পুলিশের দল। কিয়ারেশ-মাহশাকে গাড়ির কাচ নামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

পুলিশের নজরে পড়েন গাড়ির ভিতরে হিজাব না পরে বসে থাকা মাহশা। যেখানে দেশের সর্বোচ্চ নেতা বাড়ির বাইরে গেলে মহিলাদের হিজাব পরার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে এই তরুণী কী ভাবে হিজাব না পরে বেরিয়েছেন? গর্জে ওঠে পুলিশের দল। শুরু হয় আইনরক্ষকের ‘নীতিপুলিশি’।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়ির ভিতরে বসে থাকা ভাই-বোনের উপর হম্বিতম্বি শুরু করে দেয় পুলিশ। মাহশা হিজাব কেন পরেননি? বার বার করা হয় একই প্রশ্ন। মাহশার ‘দোষ’, তিনি প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছার কথা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, এর পরই রেগে আগুন হয় ওই পুলিশের দল। হিজাব না পরার ‘শাস্তি’ হিসাবে গাড়ি থেকে হিড়হিড় করে টেনে নামানো হয় মাহশাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও তাঁকে টেনে হিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তোলে পুলিশ।

ভাই কিয়ারেশকে পুলিশ জানায়, মাহশাকে ‘সহবৎ’ শেখাতে কিছু সময়ের জন্য আটকে রাখা হবে। কিছু ক্ষণ পরই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

ছাড়া পেয়েছিলেন মাহশা। তবে ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। হাসপাতালে তিন দিন কোমায় থাকার পর গত শুক্রবার তিনি মারা যান।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ‘ব্রেন ডেড’ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল মাহশাকে। হৃদ্‌স্পন্দন থাকলেও নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা পর মাহশা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পুলিশের গাড়িতে তুলতে তুলতে এবং গাড়িতে উঠিয়ে মাহশাকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ। আর সেই কারণেই তিনি কোমায় চলে যান বলেও অনেকের দাবি।

মাহশার খবর চাউর হতেই ইরানে দিকে দিকে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গত সপ্তাহের শেষে ইরানের উত্তরে কুর্দিস্তানে প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয়, যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।

মাহশার মৃত্যুর পর থেকেই ইরানের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে গণক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। হিজাব পোড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলা— বিভিন্ন অভিনব পন্থায় প্রতিবাদে নেমেছেন সে দেশের বহু পুরুষ-মহিলা।

বিক্ষোভ সামাল দিতে সরকারের তরফ থেকে রাস্তায় পুলিশ নামিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। পুলিশকে লক্ষ্য করে চলেছে ইট-পাথরের বৃষ্টি। পোড়ানো হয়েছে পুলিশের গাড়িও।

এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ৩১ জন মারা গেলেও শুক্রবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ জন। তবু দমানো যাচ্ছে না প্রতিবাদীদের। গুলি চালিয়েও সাধারণ মানুষকে ‘বাগে’ আনতে পারছে না পুলিশ।

যদিও সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সরকারের দেওয়া তথ্য ‘ভুয়ো’ বলেও দাবি ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার।

ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, ইরানের রাজধানী তেহরান জ্বলছে। সে সব ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যা নামার পরই তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।

সরকার-বিরোধী স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি কুশপুতুল পুড়িয়েও প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছে তেহরানের মানুষকে।

বহির্বিশ্বের কাছে সে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির রূপ লুকোতে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত পর পর তিন দিন ইরানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে সে দেশের সরকার।

হিজাব পরা নিয়ে বা মহিলাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সরকারে বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এই প্রথম নয়। এর আগেও হিজাব না পরার দাবি নিয়ে বহু বার রাস্তায় নেমেছেন সে দেশের মহিলারা।

তিন দশক আগেও হিজাব পরিধান করা নিয়ে তটস্থ থাকতে হত না ইরানের মহিলাদের। বরং সেই সময়ের তোলা ছবি কিন্তু অন্য কথা বলে। ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লবের সাক্ষী হন ইরানের মানুষ। পহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজা পহলভিকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার।

রাজপরিবারের উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি এবং রীতিনীতিও। এর বেশি প্রভাব পড়ে মহিলাদের উপরে। ক্ষমতায় আসার পর ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি আদেশ দেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব মহিলাকে হিজাব পরে থাকতে হবে। তার পর থেকে শুরু হয়ে পোশাকবিধি নিয়ে সরকারের কট্টর মনোভাবের বিরুদ্ধে মহিলাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস।