১৭ মে ২০২৪, শুক্রবার, ০২:৫৯:৪৪ পূর্বাহ্ন


১৩ লক্ষাধিক কর্মীর চাকরি লাভ
অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১২-২০২৩
১৩ লক্ষাধিক কর্মীর চাকরি লাভ


বিদেশে জনশক্তি রফতানির পালে হাওয়া লেগেছে। বর্হিবিশ্বের কর্মসংস্থানে সুদিন ফেরায় এখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হচ্ছে। চলতি বছর (বিদায়ী বছর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানিতে সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে গত জানুয়ারি থেকে গতকাল ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ লক্ষাধিক নারী পুরুষ কর্মী ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে শুধু সউদীতেই গেছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ গোটা বিশ্বে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছেন। প্রবাসী আয়েও আশার আলো দেখা দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের ২২ দিনে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৫৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স আসছে ৭ কোটি সাড়ে ১৩ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে, মাস শেষে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২২ দিনের এই অঙ্ক আগের মাস নভেম্বর ও গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়েও বেশি। চলতি বছরের নভেম্বরে প্রতিদিন এসেছিল ৬ কোটি ৪৩ ডলার। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
জনশক্তি রফতানিতে অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে প্রবাসে কর্মরত আত্নীয়-স্বজন এবং বায়রার সদস্যদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য মুখী না হয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মী যাচ্ছে। তবে অদক্ষ কর্মীর চেয়ে উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও বেশি বেশি দক্ষ কর্মী প্রেরণে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের ১০৪টি টিটিসি (কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) এবং ৬টি আইএমটি (মেরিন টেকনোলজী) কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ৬০টি ট্রেডে প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার নারী পুরুষ কর্মীকে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। প্রতি বছর বিদেশ গমনেচ্ছুদের তিন দিনের ট্রেনিং দেয়া হয় প্রায় ৯ লাখ কর্মীকে। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দরুণ প্রত্যেক টিটিসিতে ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষকের শূন্যপদ যুগ যুগ ধরে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে দেশ বিদেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ট্রেডে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএমইটির পরিচালক (প্রশিক্ষণ টিটিসি) সালাহ উদ্দিন আহমদ জানান, আদালতে মামলার কারণে টিটিসিগুলোর শিক্ষকের শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তবে অন্যান্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এ বছরের ন্যায় এত বেশি জনশক্তি রফতানি হয়নি। এর আগে ২০২২ সালের ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৪ জন নারী পুরুখ কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরুর পর থেকে এ যাবত প্রায় পৌনে ৪ লাখ কর্মী দেশটিতে গিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশটিতে কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভাল দিয়েছে ৫ লাখ কর্মীর। গতকাল কুয়ালালামপুর থেকে বাংলাদেশ হাই কমিশনের শ্রম সচিব শরিফুল ইসলাম ইনকিলাবকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রোমানিয়া থেকে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা প্রতি মাসেই ইউরোপের অন্যান্য দেশে ঢুকার জন্য দেশটি সীমান্ত পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গ্রেফতার হচ্ছে। এতে ইউরোপের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে গতকাল চেম্বার অব কমার্স রোমানিয়ার (এশিয়া-আফ্রিকার) হেড অব চীফ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রোমানিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের চরম উদাসিনতা ও ব্যর্থতার দরুণ দেশটি সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার হুমকির সম্মুখীন। দেশটিতে ৬ মিলিয়ন নাগরিক পেনশন সুবিধা ভোগ করছেন। আর চাকরি করে দেশ সচল রাখছেন মাত্র ৬ মিলিয়ন নাগরিক। এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী নেতা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশিদের ভিসা কমিয়ে দিচ্ছে। যারা প্রকৃতপক্ষে কাজ করবে পালাবে না সেরুপ কর্মীদেরই দেশটিতে পাঠানো উচিৎ। কিন্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা না থাকায় শ্রমবাজার অনিশ্চয়তার দিকে গড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে বৃদ্ধা নাগরিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দক্ষ এবং ইংরেজি ভাষা জানা কর্মীদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত বিজনেস রিভিউ কনফারেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাস আমন্ত্রণ পেলেও দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তা ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি। এতে শ্রমবাজার নিয়ে কথা বলার সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে রোমানিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
কতিপয় বাংলাদেশি অতি মুনাফাখোর ব্যক্তি চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত কর্মী নিয়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন এলাকার বাসা বাড়ীতে মাসের পর মাস ফেলে রেখেছে। তাদের কাজ দিতে পারছে না। ঠিকমতো খাবারের টাকাও দেয়া হচ্ছে না। দেশের বাড়ী থেকে অনেকে টাকা নিয়ে খাবার কিনে খাচ্ছে। ফলে এসব অসহায় কর্মীদের পরিবার পরিজন চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ নিয়ে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে বহু অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বাংলাদেশে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম। প্রতি বছর ২০-২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে ঢুকছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সুষ্ঠু অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় বিদেশের শ্রমবাজারে কর্মক্ষম জনবলের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সউদী সরকার ২০১৬ সালের ১০ আগষ্ট বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন খাতে কর্মী পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ২০১৭ সালে সউদী আরবে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ নারী ও পুরুষ কর্মী পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে আইএম জাপান এর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন কর্মী পাঠাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। যদিও এর সংখ্যা খুবই কম।
সূত্র বলছে, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও অন্য কর্মকর্তারা যে সব দেশে সফর করেছেন সেখানেই শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেছেন। শ্রম কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন দেশে নতুন শ্রমকল্যাণ উইং খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালেই লেবানন ও মরিশাসে দুটি শ্রমকল্যাণ উইং চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ২৭টি দেশের মিশনগুলো ৩০টি শ্রমকল্যাণ উইং অভিবাসন সমর্থিত কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। অথচ এসব শ্রমকল্যাণ উইংয়ের ব্যয় ভার বহন করতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। সউদী আরবের রিয়াদসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শত শত বাসা বাড়ীতে কর্মী নিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এদের অনেককেই চুক্তি অনুযায়ী কাজ দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দালাল চক্র। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে জনবল সঙ্কটের দরুণ অসহায় কর্মীদের সেবা প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। বায়রার সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা এ কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল জনশক্তি রফতানিতে সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জিত হওয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, শ্রমবাজার সম্প্রসারণে বিদেশে মিশনগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। তিনি বলেন, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নতুন নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে কর্মী প্রেরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তিনি বলেন, একটি রিক্রুটিং এজেন্সি এক হাজার কর্মী বিদেশে পাঠালে তার মধ্যে ২০ জন কর্মীর সমস্যা হতেই পারে। প্রবাসী কল্যাণ ও বিএমইটি কাজ হলো রিক্রুটিং এজেন্সিকে ডেকে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধান করা। কিন্ত অধিকাংশ সময় দেখা যায় সঙ্কট নিরসনের কার্যকরী উদ্যোগ না নিয়ে এজেন্সির সার্ভার লক করে দেয়া হয়। এতে জনশক্তি রফতানিকারকরা জনশক্তি রফতানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের স্বার্থে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যথাযথ সহায়তা করতে উৎসাহিত করার আহবান জানান। এতে প্রবাসী কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বাড়বে। বায়রার সাবেক নেতা শিমুল প্রবাসী কর্মীদের সৃষ্ট সঙ্কট দ্রুত নিরসনে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোকে সহযোগিতার হাত প্রসারের অনুরোধ জানান। বায়রার সাবেক নেতা মোহাম্মদ আলী রাতে জনশক্তি রফতানিতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, জনশক্তি রফতানি খাতই দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। বিদেশে কর্মী গমনের প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করতে পারলে আগামীতে এ খাতের মাধ্যমে দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে। তিনি নারী কর্মীদের বর্হিগমন প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং দ্রুত করার জোর দাবি জানান। কারণ নারী কর্মীদের নিয়োগ কর্তা রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ ১৭শ’ মার্কিন ডলার, কর্মীর মেডিকেল ফিসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আকারে দেশে পাঠায়। এতে জাতীয় অর্থনীতিই চাঙ্গা হচ্ছে।