২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০১:৩৫:২০ পূর্বাহ্ন


সন্তান লালন-পালনে কোরআনের দিকনির্দেশনা
ধর্ম ডেস্ক:
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১২-২০২২
সন্তান লালন-পালনে কোরআনের দিকনির্দেশনা ফাইল ফটো


ধন-সম্পদ আর সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ আমানত। মহান আল্লাহ মানুষকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ আমানত সন্তানাদি ও ধন-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি ৭১৩৮)

আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার আগে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনায় সন্তান-সন্তুতিদের লালন-পালন করা জরুরি। তাই নিজ নিজ সন্তানদের কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনায় এভাবে গড়ে তুলতে হবে-

সন্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা

সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে একান্ত সময় দেয়া। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা জরুরি। সন্তান যাতে যে কোনো সমস্যায় নির্দ্বিধায় মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও বিপদ থেকে রক্ষা করা যায়। যেভাবে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর স্বপ্নের কথা বাবার সঙ্গে আলোচনা করলেন; আর তিনি তাঁকে ওই স্বপ্নের ব্যাপারে কারো সঙ্গে আলোচনা করতে বারণ করেন। কোরআনে এসেছে-

اِذۡ قَالَ یُوۡسُفُ لِاَبِیۡهِ یٰۤاَبَتِ اِنِّیۡ رَاَیۡتُ اَحَدَعَشَرَ کَوۡکَبًا وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ رَاَیۡتُهُمۡ لِیۡ سٰجِدِیۡنَ

‘যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলল, হে আমার পিতা, আমি দেখেছি এগারোটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৪)

সন্তানকে সতর্ক করা

জীবন সম্পর্কে সন্তানদের অভিজ্ঞতা কম।  তাই মা-বাবার উচিত, তাদের কঠিন এই পৃথিবী সম্পর্কে সতর্ক করা, যে পথে বিপদের আশঙ্কা আছে, সে পথ এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেওয়া। যেভাব হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তাঁর বাবা এভাবে সতর্ক করেছিলেন-

قَالَ یٰبُنَیَّ لَا تَقۡصُصۡ رُءۡیَاکَ عَلٰۤی اِخۡوَتِکَ فَیَکِیۡدُوۡا لَکَ کَیۡدًا ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ

তার পিতা বললেন, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বর্ণনা কোরো না। যদি করো তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৫)

সন্তানকে সুপরামর্শ দেওয়া

প্রত্যেক সন্তানের মধ্যেই কিছু সম্ভাবনা থাকে, তা বুঝে তাকে সেই সম্ভাবনার প্রতি উৎসাহ দিলে সে সফল হতে পারে। মা-বাবার উচিত, সন্তানকে সুশিক্ষিত করার পাশাপাশি তার মধ্যে থাকা সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে তাকে উৎসাহ দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ کَذٰلِکَ یَجۡتَبِیۡکَ رَبُّکَ وَ یُعَلِّمُکَ مِنۡ تَاۡوِیۡلِ الۡاَحَادِیۡثِ وَ یُتِمُّ نِعۡمَتَهٗ عَلَیۡکَ وَ عَلٰۤی اٰلِ یَعۡقُوۡبَ کَمَاۤ اَتَمَّهَا عَلٰۤی اَبَوَیۡکَ مِنۡ قَبۡلُ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ اِسۡحٰقَ ؕ اِنَّ رَبَّکَ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ

‘(স্বপ্নে যেমন দেখেছ) এভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন, তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন এবং তিনি তাঁর অনুগ্রহ তোমার প্রতি আর ইয়াকুব পরিবারের প্রতি পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি তা আগে তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহিম ও ইসহাকের প্রতি পূর্ণ করেছিলেন, নিশ্চয়ই তোমার রব সর্বজ্ঞ, বড়ই প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৬)

তাদের বিনোদনের সুযোগ দেওয়া

সন্তানের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে খেলাধুলাসহ বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে, তাই তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ দিতে হবে। এই জন্যই ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তান ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তাঁর অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে খেলার জন্য মাঠে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَالُوۡا یٰۤاَبَانَا مَا لَکَ لَا تَاۡمَنَّا عَلٰی یُوۡسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوۡنَ  اَرۡسِلۡهُ مَعَنَا غَدًا یَّرۡتَعۡ وَ یَلۡعَبۡ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوۡنَ

‘তারা বলল, হে আমাদের আব্বাজান! কী ব্যাপার, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস করেন না কেন, অথচ আমরা অবশ্যই তার কল্যাণকামী। তাকে আগামীকাল আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিন, সে আমোদ করবে আর খেলবে, আমরা তার পুরোপুরি দেখাশুনা করব। ’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১১-১২)।

শিরক না করার নির্দেশ দেওয়া

আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক না করার ব্যাপারে ছেলেকে দেওয়া হজরত লুকমান আলাইহিস সালামের উপদেশ আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে উল্লেখ করেন এভাবে-

وَ اِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰهِ ؕ اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ

‘স্মরণ কর, যখন লুকমান তার ছেলেকে নসিহত করে বলেছিল—হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শিরক কোরো না, শিরক হচ্ছে অবশ্যই বিরাট জুলুম।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৩)

মা-বাবার খেদমতের শিক্ষা দেওয়া

মা-বাবা খেদমত করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে পাকে ইরশাদ করেন-

وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰی وَهۡنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡکُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡکَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ وَ اِنۡ جَاهَدٰکَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِکَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُکُمۡ فَاُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে, (নির্দেশ দিচ্ছি) যে আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (তোমাদের সবার) প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার অংশীদার স্থির করার জন্য, যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করবে। যে আমার অভিমুখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর আমারই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদের জানিয়ে দেব তোমরা যা করছিলে। ’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৪-১৫)

নামাজ ও সৎ কাজের শিক্ষা দেওয়া

নিজ সন্তানকে নামাজ ও সৎকাজের শিক্ষা দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া। হজরত লুকমান আলাইহিস সালামের নিজ সন্তানকে নামাজ ও সৎ কাজের নির্দেশের বিষয়টি আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেছেন-

یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ وَ اۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ انۡهَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَکَ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ مِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ

‘হে বৎস! তুমি নামায কায়েম কর। সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর মন্দ কাজ হতে নিষেধ কর...’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৭)

অহংকার থেকে দূরে রাখা

আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ সুরা লুকমান নাজিল করেছেন। হজরত লুকমান আলাইহিস সালাম নিজ সন্তানতে দুনিয়াতে বেড়ে ওঠার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। অহংকার ও দাম্ভিকতা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-

وَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّکَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ

‘অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। ’ (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৮)।

জীবনযাপনে সংযত হওয়ার নির্দেশ

দুনিয়ার জীবনে চলাফেরায় সংযত হওয়ার নির্দেশও এসেছে কোরআনের বর্ণনায়। হজরত লুকমান আলাইহিস সালাম নিজ ছেলেকে এ মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন-

وَ اقۡصِدۡ فِیۡ مَشۡیِکَ وَ اغۡضُضۡ مِنۡ صَوۡتِکَ ؕ اِنَّ اَنۡکَرَ الۡاَصۡوَاتِ لَصَوۡتُ الۡحَمِیۡرِ

‘চলাফেরায় সংযত ভাব অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো। স্বরের মধ্যে নিশ্চয়ই গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা শ্রুতিকটু।’ (সুরা লুকমান : আয়াত ১৯)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিজ নিজ সন্তানদের কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা দেওয়ার তাওফিক দান করুন। সন্তানদের সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।